পলিটেকনিক ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা কেমন আছেন?

পলিটেকনিক কলেজগুলোর ৭৭৭ জন শিক্ষক এখনো বেতন পেয়েছেন কি না জানা নেই। ঈদের আগে বেতনের দাবিতে ঢাকায় এসে ফিরে গেছেন। তাঁদের কথা আমরা ভুলে গেছি।

খবর ছিল এ রকম, দেশের ৫৪টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ৭৭৭ জন শিক্ষক ৩৮ মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না। ঈদ সামনে ছিল। কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্টের (স্টেপ) শিক্ষক তাঁরা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তাঁদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেটির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় তাঁরা ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। শরীয়তপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর ফরহাদ আলী জানান, প্রকল্প শেষ হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাঁদের মৌখিকভাবে কাজ করে যেতে বলা হয়। সে কারণে তাঁরা ৩৮ মাস ধরে ক্লাস নিচ্ছেন।

‘এই দেশ শিক্ষা আন্দোলনের ফল বললেও ভুল বলা হয় না। পাকিস্তানে প্রথম হরতাল করেছেন শিক্ষকেরা।’ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্প্রতি শিক্ষকদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষকনেতা শেখ কাওছার আহমেদ এসব অভিযোগ করেন। ৪৪ দিন কর্মসূচিতে দুজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়। ব্যর্থ মনোরথে তাঁরা বাড়ি ফিরে যান।

আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা জানান, প্রকল্প শেষে চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২২ মে অনুমতি প্রদান করেন এবং সরকারের থোক বরাদ্দ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেতন-ভাতাও দেওয়া হয়, যা ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত চলমান ছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তা বর্তমানে বন্ধ।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের চক্রে শিক্ষকদের জীবন থমকে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, এত দিন ধারদেনা করে চলেছেন। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে তাঁরা নিকট আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও টাকা ধার করতে পারছেন না। তাঁদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বৃদ্ধ মা-বাবা ও সন্তানের ভরণপোষণের আর কোনো উপায়ই দেখছেন না। অনেক শিক্ষকের শিশুসন্তানের দুধ কেনারও পয়সা নেই।

৭৭৭ জন শিক্ষক কি বিশেষ বিবেচনায় ঋণ চেয়েছেন, নাকি বেতনের টাকা তাঁরা পাচার করবেন!

২.

সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকেরা শুরুতেই মোট বেতন পান ২৭ হাজার ১০০ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পিয়ন মোট বেতন পান যথাক্রমে ১৭ হাজার ৫৩০ টাকাও ১৪ হাজার। আর এমপিওভুক্ত হাইস্কুলের শিক্ষক ১২ হাজার ৭৫০ টাকা।
সেই বেতন আবার তাঁরা পান ৭ থেকে ১০ তারিখে। পেনশন নেই। ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ৪ শতাংশ কেটে রাখা হয়। শ্রান্তি বিনোদন নেই। এবারের ঈদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বোনাস পেয়েছেন মূল বেতনের পুরোটাই আর এমপিওভুক্তরা মাত্র ২৫ ভাগ।

গৌতম কুমার (৩৮)। বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায়। এনটিআরসিএ থেকে নিয়োগ পেয়েছেন। সহকারী শিক্ষক, কৃষ্ণপুর কমলাময়ী উচ্চবিদ্যালয়, লাখাই, হবিগঞ্জ। হবিগঞ্জের এমপিওভুক্ত শিক্ষক তিনি। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। গ্রামে বৃদ্ধ মা-বাবা। বদলির সুযোগ নেই। আর যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে ন্যূনতম জীবনই যাপন করা যায় না, সেখানে নিজের একটা বাড়ি কল্পনাতেও আসে না। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া বাড়ি ফেরা হবে না।

গৌতম কুমার জানতে চান, ‘প্রতি মাসে আমার বেতনের শতকরা ১০ টাকা কোথায় জমা হচ্ছে জানি না। জিপিএফ ফান্ড হলে সরকারিদের মতো তার ওপর ঋণ নেওয়া যায় না কেন?’

‘এই দেশ শিক্ষা আন্দোলনের ফল বললেও ভুল বলা হয় না। পাকিস্তানে প্রথম হরতাল করেছেন শিক্ষকেরা।’ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্প্রতি শিক্ষকদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষকনেতা শেখ কাওছার আহমেদ এসব অভিযোগ করেন। ৪৪ দিন কর্মসূচিতে দুজন শিক্ষকের মৃত্যু হয়। ব্যর্থ মনোরথে তাঁরা বাড়ি ফিরে যান।

গণপরিষদ বিতর্কে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৭ অনুচ্ছেদের তৃতীয় পঙ্‌ক্তির ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর’ শব্দাবলির পরিবর্তে ‘একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দশম শ্রেণি’ শব্দাবলি সন্নিবেশ করার দাবি জানিয়ে বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য সুস্পষ্ট। গত আন্দোলনে আমাদের সামনে যে ৬ দফা ও ১১ দফা ছিল, তাতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক শিক্ষাদানের কথা ছিল। সুতরাং এই সংশোধনী গৃহীত হলে সেই দাবি এখানে স্বীকৃতি পাবে।’

পরে আর স্বীকৃতি পায়নি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের তিন জোটের রূপরেখাতেও ছিল একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সর্বজনীন শিক্ষার কথা। শিক্ষার মুখ তো আরও বেড়েছে। তারই ফল কি শিক্ষকেরা ভুগছেন?