২০৪৮ সালের খবরের কাগজ কেমন হবে

আজ থেকে ২৫ বছর আগে দেশে একটা নতুন সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে শুরু করে। নাম ছিল প্রথম আলো। নাম শুনে কেউ কেউ কিন্তু বলেছিলেন, এটা কোনো খবরের কাগজের নাম হতে পারে নাকি! ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই’—রবীন্দ্রনাথের গান থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাম ‘প্রথম আলো’। শামসুর রাহমানের কবিতায় আছে, ‘কাঁচা দুধের মতো ভোরের শাদা আলো।’ দ্রুতই পত্রিকাটা মানুষের প্রিয় হয়ে ওঠে, আর প্রিয় মানুষের নামের মতো প্রথম আলো নামটাও আমাদের কাছে বড় মধুর বলে মনে হতে থাকে।

আগামীকাল প্রথম আলোর রজতজয়ন্তী। প্রথম আলোর মূল কাগজ ছিল ১২ পৃষ্ঠা, সঙ্গে ৪ পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র। প্রতিদিনই রঙিন। সে সবই ছিল অভিনব।

পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে সক্ষম হয়। এর কারণ, বাইরের দিক থেকে দেখলে, নতুনত্ব, আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা। আর ভেতরের দিকে তাকালে, প্রথম আলোর পাঠকপ্রিয়তার কারণ এর দলনিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং সত্য কথা বলার সাহস।

সব সরকারের আমলেই পত্রিকাটি শাসকদের বিরাগভাজন হয়, প্রথম আলোয় সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া বিএনপি সরকারের আমলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও। এটাকেও একটা দিকদর্শন যন্ত্রের কাঁটা হিসেবে দেখা যায়, যদি সরকারমাত্রই কোনো সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ করে, তাহলে বুঝতে হবে, মাধ্যমটি ঠিক পথেই আছে।

কারণ, সংবাদমাধ্যমের কাজই ক্ষমতাকে পাহারা দিয়ে রাখা। যেকোনো দেশে ক্ষমতা দুর্বিষহ নিপীড়নতন্ত্রে পরিণত হতে পারে; যদি না থাকে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ।

উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে নোবেল পুরস্কার ভাষণে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেছিলেন, ‘মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি।’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দমন-পীড়ন, নির্যাতন, লুটতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও আমাদের উত্তর হচ্ছে: জীবন। না বন্যা না মহামারি, না বুভুক্ষা না প্রলয়ঝড়, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চিরকাল বয়ে চলা যুদ্ধবিগ্রহেও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করে দিতে পারেনি।’

প্রথম আলোর সাফল্যের পেছনে একজন মানুষের অবদান এবং পরামর্শের কথা আজকের দিনে বিশেষভাবে স্মরণ করতেই হবে। তিনি হলেন মিডিয়া স্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। তিনি সংবাদমাধ্যমের লোক ছিলেন না, কিন্তু আশ্চর্য রকমের দূরদর্শী ছিলেন।

তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও বিচক্ষণতার কোনো তুলনা হয় না। তিনি বলে দিয়েছিলেন, ব্যক্তি হিসেবে আপনাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক মত থাকতে পারে, কিন্তু যখন আপনি লিখবেন, আপনাকে হতে হবে দলনিরপেক্ষ।

তিনি সাংবাদিকদের সততার ওপর খুব জোর দিতেন। আর তিনি কোনো দিনও জানতে চাইতেন না, কাগজে কী ছাপা হবে না হবে। এই সিদ্ধান্ত সম্পাদকের। তিনি বলতেন, আপনারা নিজের আয়ে চলুন, তাহলে আপনাদের আর বিনিয়োগকারীদের কথাও শুনতে হবে না, সরকার কিংবা প্রভাবশালী মহলের দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না।

তিনি বলতেন, সংবাদমাধ্যমের বড় পুঁজি হলো মানবসম্পদ, সাংবাদিকেরা; এখানেই বড় বিনিয়োগটা করতে হবে। করে দেখুন, ফল পাবেন। তাঁর এই কথা যে ফলেছে, তার প্রমাণ তো বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সার্বিক চিত্র থেকেই দেখা যায়।

প্রথম আলোর প্রথম দিন থেকেই অনলাইন সংস্করণ চালু করা হয়নি। তবে ছাপা কাগজ প্রকাশের এক বছরের মধ্যে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে  প্রথম আলো ডট কম প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথম আলো ডট কম এখন সারা বিশ্বের এক নম্বর বাংলা ওয়েবসাইট। প্রতি মাসে ২১ কোটি ভিউ হয় এই ওয়েবসাইটের।

তা সত্ত্বেও এখনো ছাপা কাগজের শক্তি ও প্রভাব বেশি বলে গণ্য হয়। পৃথিবীর পত্রিকা-বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘ডিজিটাল ফার্স্ট বাট প্রিন্ট ইজ প্রুফ। ডিজিটাল ইজ ফিউচার বাট প্রিন্ট ইজ ইম্পর্টান্ট।’

প্রথম আলো ব্যাপারটা মনে রাখে। পরিবর্তনের সঙ্গে গেলে চলবে না, পরিবর্তনের আগে থাকতে হবে। পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির দ্বারা চালিত হওয়া যাবে না, প্রযুক্তিকেই চালিত করতে হবে। কেন? সেই যে মৌলিক কাজ চারটা— মানুষকে তথ্য, শিক্ষা, বিনোদন এবং প্রণোদনা জোগানো, তা করার জন্য সর্বাধুনিক সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে হবে।

১৬০৫ সালে জার্মানিতে প্রথম ছাপা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ৪০০ বছরে কম চড়াই-উতরাই তো যায়নি। রেডিও এল, সিনেমা এল, টেলিভিশন আসার পর তো মনে হলো, আর কেউই সংবাদপত্র পড়বে না। কিন্তু সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা বরং আরও বেড়ে যেতে লাগল। এখন এসেছে ইন্টারনেটের যুগ। হাতে হাতে স্মার্টফোন।

ব্রেকিং নিউজ লোক পায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক হয়ে উঠেছে প্রাথমিক খবরের উৎস। সেখানেই সংবাদপত্রের শক্তি। ফেসবুকে প্রকাশিত খবর দেখে বলা যায় না, খবরটা সত্য নাকি মিথ্যা। তখন যেতে হয় লেজিটিমেট সংবাদমাধ্যমের কাছে।

যদি প্রথম আলো বলে, এই ঘটনা ঘটেছে, তাহলেই লোক তা মেনে নেয়। এখানেই লেজিটিমেট সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বটা বেড়ে যায়। তাকে সত্য দিতে হবে, বারবার যাচাই-বাছাই করে সঠিক খবরটা পরিবেশন করতে হবে।

এমবার্তো একো বলেছেন, কিছু জিনিস আছে, একবার আবিষ্কৃত হয়ে গেলে তার আর উন্নতির দরকার পড়ে না। যেমন চামচ, চাকা, কাঁচি। তেমনই একটা জিনিস বই। এটা আছে, এবং থাকবে। সংবাদপত্রও থেকে যাবে। এমনকি ছাপা কাগজও থেকে যাবে।

কারণ, প্রিন্ট ইজ প্রুফ। ছাপা কাগজ আপনি হাতে রাখবেন, এটাই তো প্রমাণ।
তবে এই আশায় বসে থাকারও উপায় নেই। আমাদের প্রিয় ক্যাসেট প্লেয়ারের সেই ফিতাওয়ালা ক্যাসেট কই, কোথায় কোডাক বা ফুজি ফিল্মের কৌটাগুলো! নকিয়া ফোনসেটের বাজার অন্য কেউ নিতে পারবে, একসময় তা ছিল অকল্পনীয়। কাজেই আজ থেকে ২৫ বছর পর প্রথম আলো কিংবা সংবাদমাধ্যমগুলো কী আকার নেবে, আমরা জানি না।

দেশের উন্নতি তো হতেই হবে। বাংলাদেশের লড়াকু হার না-মানা মানুষ দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাবেই, দেশ উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হবে। এর শিকারে পরিণত হবে আমাদের পরিবেশ, পানি, নদী, বন, মাটি, আকাশ, বাতাস। তবে মাথাপিছু আয় বাড়লে সুশাসনও আসতে বাধ্য।

এই সবকিছুর জন্য অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে হবে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে। সরকারের ভুল ধরে দেওয়াই সংবাদমাধ্যমের কাজ। গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে রক্ষা করে যেতে হবে চোখের মণির মতো।

আমরা জানি, দেশে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পরিসর ছোট হয়ে আসছে। সংবাদমাধ্যমে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একের পর এক কালাকানুন নতুন নতুন নাম নিয়ে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরতে চাইছে কণ্ঠস্বর। কাজেই আমাদের পথ ফুল বিছানো নয়। তফাজ্জল হোসেনের (মানিক মিয়া) মতো সম্পাদকেরা জেলে গেছেন। তাঁদের সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কঠিন থেকে কঠিনতর সময় আসতে পারে।

অন্যদিকে ছাপা সংবাদপত্র লাভজনক রাখা খুব কঠিন। হকার এজেন্টরা কত দিন এ ব্যবসায় থাকবেন, বলা মুশকিল। তারপরও সংবাদপত্র, খবরের কাগজ, ছাপা কাগজ ২০৪৮ সালেও টিকে থাকবে বলে আমরা আশা করতে পারি। কাগজটা বদলে যেতে পারে। ই-ইংক নামের একটা নতুন জিনিস আসছে।

প্রযুক্তি বদলে কোথায় যাবে, আমরা জানি না। হয়তো মুখে বললেই হবে, আজকের প্রথম আলো, অমনি আমার সামনে বিশাল একটা শূন্য পর্দায় প্রথম আলো হাজির হবে। অডিও-ভিডিও খবরসমেতই।

আর অনলাইন তো থাকবেই। সেটা হয়তো পড়ব নখদর্পণে। মানে আমার বুড়ো আঙুলের নখটাই হবে পর্দা। এআই, ইন্টারনেট অব থিংস, থ্রি-ডি প্রিন্টার আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, আমরা জানি না।

তবু যা থাকবে, তা হলো, শাসন, ক্ষমতা-সম্পর্ক, নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম। কাজেই সংবাদমাধ্যমকে থাকতেই হবে। সংবাদমাধ্যম হলো আশাহীনের আশা, ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা, কণ্ঠহীনের কণ্ঠ।

নোবেল পুরস্কার ভাষণে আলবেয়ার কামু ১৯৫৭ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা হিটলারের উত্থান দেখেছি, অ্যাটম বোমার ভয়াবহতা দেখেছি।’ তিনি বলেন, ‘আর্টিস্টের কাজ ক্ষমতার সঙ্গে থাকা নয়, বরং যে লোকটা জেলে পচে মরছে, তার পাশে থাকা।’

আর উইলিয়াম ফকনারকে উদ্ধৃত করে নোবেল পুরস্কার ভাষণে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (১৯৮২) বলেছিলেন, ‘মানুষের অবসান মেনে নিতে আমি অস্বীকার করি।’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত দমন-পীড়ন, নির্যাতন, লুটতরাজ, আত্মবিক্রয় সত্ত্বেও আমাদের উত্তর হচ্ছে: জীবন। না বন্যা না মহামারি, না বুভুক্ষা না প্রলয়ঝড়, এমনকি শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে চিরকাল বয়ে চলা যুদ্ধবিগ্রহেও মৃত্যুর ওপর জীবনের নাছোড় প্রাধান্যকে হ্রাস করে দিতে পারেনি।’

মার্কেস বলেছিলেন, ‘মানুষের পরাজয় নেই, তা এ জন্যে না যে তার ভাষা আছে, তা এ জন্যে যে তার আত্মা আছে।’ বাংলাদেশের মানুষদের আছে আত্মা। বাংলাদেশের মানুষদেরও পরাজয় নেই।

প্রথম আলো বেঁচে থাকুক সেই অবিনাশী মানুষের অপরাজেয় আত্মার কণ্ঠস্বর হয়ে।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক