বড় কোনো ঘটনা ঘটার আগে কিছু ছিটেফোঁটা সংকেত ধরা পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে তার অনেকগুলোই চোখে পড়ছে। দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে—এটা শুধু বিপদের খবর নয়, ভবিষ্যতের ঝুঁকিরও ইঙ্গিত। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইন্টারনেটের ওপর অনেকটাই শিথিলতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু সমাজে অস্থিরতার লক্ষণও স্পষ্ট হচ্ছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, রাস্তায় মব কালচার চলছে, আর যেকোনো ইস্যুতেই কাদা–ছোড়াছুড়ি সামাজিক বিভক্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্ব অর্থনীতিতেও অস্থিরতা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধ, আর যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ-পাল্টা ট্যারিফের লড়াই—সব মিলিয়ে আমদানিনির্ভর দেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলছে। মানুষ গরিব থেকে গরিবতর হচ্ছে অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সেই পরিবর্তনের প্রতিফলন মিলছে না। শহরের রাস্তায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিও অবনতির পথে।
এ অবস্থায় ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও বৈশ্বিক চাপে তারাও খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এআই, অটোমেশন ধীরে ধীরে ঢুকছে বিজনেস হাউসগুলোতে। ছোট ছোট ব্যবসা নাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাকরি, ব্যবসায়িক মূলধন হারাচ্ছে মানুষ, আর সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলের ওপর চাপ বাড়ছে। এখন আসল চ্যালেঞ্জ, কারা প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত, তা নির্ধারণ করা।
প্রক্সি মিনস টেস্ট বা পিএমটি এখানে বহুল ব্যবহৃত একটা পদ্ধতি। এটি সরাসরি আয়ের হিসাব না নিয়ে বরং ঘরবাড়ি, সম্পত্তি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা ইত্যাদি দেখে একটি স্কোর নির্ধারণ করে। যাদের স্কোর কম, তাদের সুবিধাবঞ্চিত ধরা হয়। তবে এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা আছে—ভুল তথ্য দেওয়া বা পুরোনো ডেটার কারণে ফলাফল ভুল হতে পারে।
কোভিড-১৯–এর সময় আমরা এর এক অভিনব বিকল্প হাতে পেয়েছিলাম। অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত চিহ্নিত করা যায়। পরিকল্পনাটা নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলাম ভেতরে-ভেতরে। জিনিসটা সহজ কিন্তু কার্যকর।
আমার ধারণা, এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। মানুষের জীবনযাত্রা যখন সংকটের প্রান্তে, তখন প্রযুক্তি ব্যবহার না করা হবে অপচয়, অদক্ষতা। আমরা যেন একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পানি বাড়ছে, কিন্তু সাঁতার শিখছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানবিক রাষ্ট্র গড়ার পথে হাঁটতে হবে আমাদের, বিভক্তি ফেলে, হাতের ডেটাকে বিশ্বাস করে।
মোবাইল অপারেটরের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) ডেটায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বহু ইঙ্গিত থাকে। দিনে কতক্ষণ কথা বলে, কার সঙ্গে বেশি কথা বলে, কয়জন কল করে, কত টাকা রিচার্জ করে—সবকিছুই সেখানে ধরা থাকে। মেশিন লার্নিং এই ডেটা বিশ্লেষণ করে মানুষের আয়ের একটা নির্ভুল অনুমান দিতে পারে।
শুধু তা–ই নয়, মোবাইল টাওয়ারের বেজ স্টেশন ডেটা বলে দিতে পারে, একজন দিনে কোন এলাকায় থাকে আর রাতে কোথায় ঘুমায়। এতে বোঝা যায় সে বস্তিতে থাকে নাকি অ্যাপার্টমেন্টে। ডিভাইসের তথ্য থেকেও আয়ের ধারণা মেলে সে কি আইফোন ব্যবহারকারী, নাকি সাধারণ ফিচার ফোন ব্যবহার করছে।
সব ডেটাই থাকে অ্যানোমাইজড, মানে নাম বা নম্বর ছাড়া কেবল পরিসংখ্যান। এতে প্রাইভেসি বজায় থাকে, কিন্তু নীতি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়। এই তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া যায় মেশিন লার্নিং মডেলে, যা মানুষের আয়ের সক্ষমতার একটা স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, নীতিগত কিছু বাধার কারণে তখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। আমার ধারণা, এখন সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। মানুষের জীবনযাত্রা যখন সংকটের প্রান্তে, তখন প্রযুক্তি ব্যবহার না করা হবে অপচয়, অদক্ষতা। আমরা যেন একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে পানি বাড়ছে, কিন্তু সাঁতার শিখছি না। আর সবচেয়ে বড় কথা, মানবিক রাষ্ট্র গড়ার পথে হাঁটতে হবে আমাদের, বিভক্তি ফেলে, হাতের ডেটাকে বিশ্বাস করে।
রকিবুল হাসান টেলিকম, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-বিষয়ক বইয়ের লেখক এবং লিংকথ্রি টেকনোলজিসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা