স্বাধীনতার জন্য জীবনকেই জিম্মি করেছিলেন তিনি

সাত দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ও আলোড়িত নাম শেখ মুজিবুর রহমান, দেশবাসী যাঁকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হিসেবে অভিষিক্ত করেছে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি একটি লক্ষ্যেই আবর্তিত হয়েছে—এ দেশের মানুষের মুক্তি। তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা সে সময় ভাবতেন, মুসলমানদের আলাদা বাসভূমি হলেই তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে যেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি অধস্তন হয়েই থাকল।  

দেশ ভাগের আগে কলকাতায় ইনার সার্কেল গঠন, ঢাকায় এসে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তরুণ নেতা শেখ মুজিবের কারান্তরীণ হওয়ার পেছনে ছিল এ দেশের মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তাঁর ভাষণ বিশ্লেষণ করলেও এর সত্যতা মিলবে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর শেখ মুজিব বুঝতে পারলেন, পাকিস্তানে কেবল গণতান্ত্রিক উপায়ে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায় করা যাবে না।

ষাটের দশকে শেখ মুজিবের আগরতলা যাত্রা কিংবা বিদ্রোহী বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের সঙ্গে তাঁর নিজেকে যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল এ দেশের স্বাধীনতা। ষাটের দশকে স্বাধীনতাকামী যতগুলো গোপন ও প্রাকাশ্য উদ্যোগ ছিল, তার প্রায় সবই শেখ মুজিবকে কেন্দ্র করে কিংবা তাঁর সমর্থন পাবে—এই প্রত্যাশা নিয়ে তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন।

আরও পড়ুন

এ প্রসঙ্গে ১৯৬১ সালে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ধারাবাহিক কয়েক দফা বৈঠকের কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি। সেই বৈঠকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ একযোগে কীভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, সেসবই স্থির হয়েছিল। আলোচনার একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীনতা।’ কমিউনিস্ট নেতারাও স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিলেন না। তাঁরা বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য আগে দেশবাসীকে প্রস্তুত করতে হবে। তাঁদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শেষ কথা ছিল, ‘দাদা, আপনাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিমাদের সঙ্গে থাকা যাবে না।’ একই কথা তিনি বলেছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সহযোগী আসামিদের কাছেও।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন; কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে সীমিত ছিল না। ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধীদলীয় নেতাদের সম্মেলনে যে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তাজউদ্দীন আহমদসহ দু-একজন ছাড়া সে বিষয়ে দলের কেউ জানতেন না।

লাহোর থেকে ফিরে আসার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সেই কর্মসূচি শুধু অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়নে দলের নয়, তিনি বাঙালি সিএসপি কর্মকর্তা ও প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ-অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নিয়েছিলেন। ছয় দফা কর্মসূচির আগেই বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’ তত্ত্ব দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে হকচকিত করে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর আগেও অনেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাতান্ন সালে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন। কেউ কেউ স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আওয়াজও তুলেছিলেন। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্যে স্থির থাকেননি। এক দল বামপন্থী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতিগত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন।

যে কারণে সত্তরের নির্বাচনের আগে তাঁরা বলেছিলেন ভোটের আগে ভাত চাই। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার মাধ্যমে পাকিস্তানিদের সঙ্গে এ দেশের মানুষের প্রধান দ্বন্দ্বটি তুলে ধরেছিলেন বলেই শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে সবার সমর্থন পেয়েছিলেন। ছয় দফা কর্মসূচির তাৎপর্য অন্যান্য বাঙালি নেতা অনুধাবন না করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঠিকই করেছিল। এ কারণে আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দিয়েছিলেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু  ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান প্রমুখ অর্থনীতিবিদকে ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিতে বলেন। ড. নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করলে এক পাকিস্তান থাকে না। বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, ‘সেটা আপনাদের দেখার বিষয় নয়।’ (বাংলাদেশ: জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা, লেখক: নুরুল ইসলাম)
এর মাধ্যমে তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথাই জানিয়ে দিয়েছিলেন। 

পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল, তাঁরা যথেষ্ট প্রগতিশীল বা গণমুখী কর্মসূচি নেননি। এ প্রসঙ্গে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতির কথা বলা যায়। তৎকালীন জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগ তো বটেই, ছাত্র ইউনিয়নও এর বিরোধিতা করেছিল। তাদের আপত্তি ছিল, এই শিক্ষানীতি দিয়ে সমাজতন্ত্রাভিমুখী সমাজ গঠন করা যাবে না। এরপর প্রতিটি সরকার এসে একেকটি শিক্ষানীতি দিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনই ছিল তুলনামূলক প্রগতিশীল ও বাস্তববাদী। অন্যদিকে পঁচাত্তর–পরবর্তী রাজনীতি ক্রমেই পেছনে হাঁটা। একসময়ের অতি বিপ্লবীরা ইসলামি জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষা নিতেও দ্বিধা করেননি।

বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি, ভূমি ও শিল্পনীতি নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে। সমালোচনা থাকতে পারে তাঁর পৌনে চার বছরের শাসনকালে গৃহীত বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি নিয়েও। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর চেয়ে অগ্রসর কোনো নীতি ও কর্মসূচি কোনো সরকার নিয়েছে, বলা যাবে না।

আরও পড়ুন

সমালোচকদের অনেকে প্রশ্ন করেন, স্বাধীনতার প্রধান নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে কেন গ্রেপ্তার হলেন? কেন তিনি পালিয়ে গেলেন না? বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন না যে দেশের ভেতরে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করবেন। তাঁর সহযোগীরা যেভাবে কলকাতার একটি বাড়িতে থেকে প্রবাসী সরকার পরিচালনা করেছেন, তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। তখন পাকিস্তানিরা তাঁকে ভারতের চর ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করত। এই দুই বিকল্পের চেয়ে তিনি নিজের জীবনকেই জিম্মি করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য।

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অতুলনীয় সাফল্যের পাশাপাশি একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি যেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন, সেই দলের নেতা-কর্মীদের সেভাবে তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন সব সময়েই থেকে যাবে। কারণ, তাঁর মৃত্যুর পর দলীয় নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে শক্ত কোনো প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। তাঁর মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখেই মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় শপথ নেন। পরবর্তীকালে কেউ কেউ জিয়াউর রহমান ও এরশাদের মন্ত্রীও হন। কিন্তু যাঁরা তাঁর সত্যিকারের সহযাত্রী ছিলেন, যেমন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এইচ এম কামারুজ্জামান—মরণেও তাঁর সঙ্গী হলেন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি  বাংলাদেশ নামে ভূখণ্ডটি স্বাধীন করেছেন। কেউ তাঁকে রুশ-ভারতের দালাল বলে অপবাদ দিয়েছেন। কেউ চিহ্নিত করেছেন ওয়াশিংটনপন্থী হিসেবে। কিন্তু যেই মানুষটি একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন, তিনি যে কোনো পন্থী হতে পারেন না, নিজের জীবন দিয়েই সেটা প্রমাণ করেছেন। 

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    [email protected]