শিশুর জন্য আলাদা সংবাদপত্র নেই কেন?

আনিকার (ছদ্মনাম) বয়স ৯ বছর। সে ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। আনিকার মায়ের সঙ্গে কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে। আনিকার মা বলছিলেন বই কিংবা যেকোনো পাঠ উপকরণের প্রতি তাঁর মেয়ের দুর্নিবার আকর্ষণ সম্পর্কে। নিয়মিত আনিকার জন্য গল্পের বই জোগাড় করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তাঁরা।

যেখানে অধিকাংশ পরিবারই শিশুর মোবাইল কিংবা গ্যাজেটনির্ভর বিনোদন নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, সেখানে আনিকার বিষয়টি একেবারেই আলাদা। বুঝলাম, পারিবারিক সহযোগিতা ছাড়া পাঠাভ্যাসের এ ধরনের উদাহরণ বিরল।

বই পড়ার উপযোগী পারিবারিক পরিবেশ তৈরির গল্পটাও জেনে নিলাম আনিকার মায়ের কাছ থেকে। তাঁর অভিযোগ, শিশুদের বয়স উপযোগী, গুণগত মানসম্পন্ন পঠন উপকরণের খুব অভাব বাজারে। এ ছাড়া শিশুদের বইয়ে রয়েছে ভুলে ভরা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের ছড়াছড়ি। রয়েছে প্রচুর জেন্ডার অসংবেদনশীল বিষয়বস্তু। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে এ ধরনের উপকরণ জেনেবুঝে তিনি সন্তানের হাতে তুলে দিতে পারেন না। ফলে ঘুরেফিরে কয়েকটি শিশুতোষ প্রকাশনার বই–ই তাঁর ভরসা, যার অধিকাংশই আনিকা পড়ে ফেলেছে।

আনিকার মা বলছিলেন, তাঁর মেয়ের সংবাদপত্র পড়ার খুব শখ। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো শিশুবান্ধব না হওয়ায় সংবাদপত্র হাতে নিয়েও উল্টেপাল্টে রেখে দেয় আনিকা। তিনি বলছিলেন, ‘যদি অন্তত একটি মানসম্পন্ন শিশুতোষ দৈনিক সংবাদপত্র হাতে পেতাম, তাহলে আমাদের হয়তো প্রায়ই হন্যে হয়ে আনিকার জন্য বই খুঁজতে হতো না।’

ভেবে দেখলাম, আমাদের দেশে শিশু-কিশোরদের জন্য নেই আলাদা কোনো সংবাদপত্র। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শিশুদের জন্য বিশেষায়িত কোনো দৈনিক পত্রিকার জন্ম দিতে পারেনি বাংলাদেশ; না ইংরেজিতে, না বাংলায়। অথচ এই দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই শিশু।

বেশ কিছু মাসিক, ত্রৈমাসিক কিংবা ষাণ্মাসিক শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন বা পত্রিকার অস্তিত্ব আছে বটে, তবে সেগুলো চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। প্রচলিত পত্রিকার দুই-তিনটি ছাড়া বাকি পত্রিকাগুলো গ্রহণযোগ্যতা বা বাজার কোনোটিই তৈরি করতে পারেনি।

আমাদের দেশে অধিকাংশ সংবাদপত্রই সপ্তাহের যেকোনো একটি দিনে একটি পাতা শিশুদের জন্য নির্ধারিত রাখে। কিন্তু বিষয়বস্তু ও গুণগত মান বিবেচনায় সেগুলোর কয়টি শিশুবান্ধব হয়ে ওঠে, তা এক বড় প্রশ্ন। অথচ বিশ্বের অনেক দেশেই দাপটের সঙ্গে বড়দের পত্রিকার পাশাপাশি শিশুদের সংবাদপত্র জায়গা করে নিয়েছে। লাখ লাখ শিশু-কিশোর সেসব পত্রিকার নিয়মিত পাঠক।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের চিলড্রেনস নিউজ পেপার, কিডস এইজ কিংবা রবিন এইজের কথা; অস্ট্রেলিয়ার ক্রিঙ্কলিং নিউজ; ইংল্যান্ডের ফার্স্ট নিউজ, যুক্তরাষ্ট্রের কিডজ পোস্ট বা ঘানার ট্রেজার নিউজের কথা।

এসব শিশুতোষ সংবাদপত্রের সব কটিই যে প্রতিদিন প্রকাশিত হয়, তা কিন্তু নয়। এগুলোর কোনোটি দৈনিক, কোনোটি সাপ্তাহিক, কোনোটি আবার সপ্তাহে তিন দিন কিংবা চার দিন প্রকাশিত হয়। এই সংবাদপত্রগুলোয় শিশুদের বয়স, যোগ্যতা ও পছন্দকে মাথায় রেখে সংবাদের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয় এবং আকর্ষণীয়ভাবে সেগুলো উপস্থাপন করা হয়। এগুলোতে শুধু সংবাদ থাকে না; সংবাদের পাশাপাশি শিশুর মনোরঞ্জনে থাকে গল্প, ছড়া, কবিতা, পাজলস, কমিকস, গেমসহ অনেক আয়োজন।

অনেকেই ভাবতে পারেন, যেখানে গল্পের বই কিংবা পত্রিকাই শিশুরা পড়ছে না, সেখানে তারা প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়বে কেন? এ ক্ষেত্রে যুক্তিটি হলো শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বাস্তবতা এই যে, শুধু শিশুরা নয় আমরা বড়রাও বই পড়ার অভ্যাস থেকে এখন অনেক দূরে সরে এসেছি। কিন্তু সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস এখনো কিছুটা হলেও বেঁচে আছে। কাগজে কিংবা অনলাইনে আমরা অনেকেই নিয়মিত সংবাদ পড়ি। তাই এখনো বেঁচে থাকা ভালো এই অভ্যাসটিই আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি শিশুদের মধ্যে।

সমস্যা হলো, প্রচলিত সংবাদপত্রের বিষয়বস্তু, ভাষার প্রয়োগ, উপস্থাপন, লেখার ফন্ট, পৃষ্ঠার আকার, সংবাদের পরিবেশন কোনো কিছুই শিশুর উপযোগী নয়। তাই কাগজে কিংবা ডিজিটাল স্ক্রিনে সংবাদপত্রের উপস্থিতি শিশুর জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না, শিশুকে আকৃষ্ট করে না। অথচ বড়দের পত্রিকার পাশাপাশি বাড়িতে শিশুতোষ একটি সংবাদপত্রের নিয়মিত উপস্থিতি শিশুদের মধ্যে একধরনের তাগিদ সৃষ্টি করতে পারে যে সংবাদপত্র শিশুর জন্যও প্রতিদিনের পাঠ্যবিষয়।

শিশুদের সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাসংখ্যা কম হতে পারে, সপ্তাহের সাত দিন প্রকাশিত না–ও হতে পারে। তবে শিশুতোষ সংবাদপত্রের উপস্থিতিটা খুব জরুরি। এ ছাড়া সংবাদপত্রের আকার ছোট হতে হবে, যেন তা শিশুর পক্ষে সহজেই ব্যবহার উপযোগী হয়। সেই সঙ্গে লেখার ফন্ট বা আকার বড় হতে হবে, প্রচুর রঙের ব্যবহার থাকতে হবে। শিশুদের জন্য সংবাদ নির্বাচন ও সংবাদের পরিধি নির্ধারণ করতে হবে খুব সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। শুধু বিনোদন কিংবা আনন্দ আয়োজন নয়। শিশুরা যেন সংবাদপত্র পাঠ করে প্রয়োজনীয় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে, সে জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।

শিশুদের জন্য আমাদের প্রচলিত ভাবনা হলো, আজকের শিশু আগামীর নাগরিক। কিন্তু আমার মনে হয়, এ ধরনের উক্তির মাধ্যমে আমরা অনেক সময় শিশুর ক্ষমতাকে উপেক্ষা করি এবং শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় অনেক আয়োজনকে আমরা গুরুত্ব দিই না।

প্রকৃতপক্ষে শিশুর যোগ্যতা ও সক্ষমতা শিশুর অস্তিত্বের মতোই প্রাঞ্জল এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা বড়দের চেয়ে বেশি যোগ্যতর ও সক্ষম। তাই শিশুকে শুধু ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য করে তুললে হবে না। শিশুর মধ্যে বসবাসকারী ক্ষমতাকে পূর্ণভাবে স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই ক্ষমতাকে আরও শাণিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিশুতোষ সংবাদপত্রের প্রচলন শিশুর পূর্ণতা বিকাশে হতে পারে একটি অনন্য আয়োজন। পরিশেষে বলতে চাই, শিশুর অন্তরে জাগ্রত ও বিকশিত হোক জ্ঞানের মহিমায় উদ্ভাসিত আগামী।

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী
    [email protected]