রাজনীতিতে ‘আপসহীনতার’ বিকল্প পথ কী?

ষড়্ঋতুর দেশ বাংলাদেশে নিয়মিত বিরতিতে আবহাওয়া বদলালেও এ দেশের রাজনীতিতে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। বড় ও জটিল কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ‘অপারেশন ম্যানুয়াল’ অথবা ‘স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল’ থাকে। কোন পরিস্থিতিতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা ধারাবাহিকভাবে ওই ম্যানুয়াল বা প্রটোকলে লেখা থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতিও যেন ‘ম্যানুয়ালে’ লেখা রীতিতেই চলছে।

প্রতি পাঁচ বছর পরপর, শীতের মাঝামাঝি, জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। বর্ষা শেষে, ওই নির্বাচনের আগে, শরৎজুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি সভা-সমাবেশ, রোডমার্চ, প্রতীকী অনশন ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে ওয়ার্মআপ বা গা গরমের আন্দোলন করবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টিকটু তৎপরতা সে সময় চোখে পড়বে। জনমানুষের ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠার জন্য হেমন্তের দুই মাস চলবে হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। পুলিশের গুলি আর বিরোধীদের বোমা-আগুনে প্রাণ যাবে নিরীহ কিছু মানুষের।

‘ফার্স্ট রাউন্ডের’ এই আন্দোলনের সময় সরকারের আচরণ হবে প্রচণ্ড মারমুখী। ছোট-বড়-মাঝারি সব পর্যায়ের বিরোধী রাজনীতিকদের নির্বিচার গ্রেপ্তার করা হবে। বিরোধী বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বানচালের পণ করলেও আন্দোলনের ‘ফাইনাল রাউন্ডের’ মাঝেই, শীতের কোনো এক দিনে পুলিশ আর প্রশাসনের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সরকারি দল ঠিকই নির্বাচন করে ফেলবে। সরকার-ঘনিষ্ঠ কিছু বিরোধী দলও নির্বাচনে অংশ নেবে। তারপর নতুন সরকারের ‘হানিমুন’ পর্যায়ে বিরোধীরা শুরু করবে নির্বাচনপরবর্তী আন্দোলন পর্ব। মাসখানেকের মধ্যে সেই আন্দোলনের প্রদীপ নিভে যাবে। পাঁচ বছর পর আবারও একই ঘটনাক্রমের পুনরাবৃত্তি।

কিন্তু এভাবে আর কত দিন? আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যে অচলায়তন জেঁকে বসে আছে, তা ভাঙার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশক পরেও একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার বদলের শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা করতে না পারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এক চরম ব্যর্থতা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অচলায়তন ভাঙার জন্য পূর্বকালের গণ্ডি অতিক্রম করে সমকালের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যদি এবার পুরোনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে, তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতি একটা সংলাপের আয়োজন করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন সম্ভবত এ মাসের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার আগেই রাষ্ট্রপতির উচিত হবে প্রধান দলগুলোকে নিয়ে সংলাপ আয়োজন করা। সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান অচলাবস্থার অবসান হলে দুই দলেরই মান রক্ষা হবে।

কয়েক দশক ধরে চলা বহু ব্যবহারে জীর্ণ বাংলাদেশের রাজনীতির ‘অপারেশন ম্যানুয়াল’ পরিবর্তনের জন্য সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপি যদি এখনো মনে করে যে রাজপথে শক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন।

আর আওয়ামী লীগ যদি মনে করে যে বিএনপিকে বাদ দিয়ে ‘প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের’ মাধ্যমে তারা আবারও পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় থেকে যেতে পারবে, তাহলে তারা ভুল করবে। বর্তমানের বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস অথবা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাতের সম্ভাবনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় বিএনপিকে বাদ রেখে নির্বাচন করে পূর্ণ মেয়াদে টিকে থাকা আওয়ামী লীগের জন্য প্রায় অসম্ভব হবে।

প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। সেই বিবেচনায় এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল রাজনীতিবিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ৪২ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে তিনি দুই দফায় প্রায় ২০ বছর বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে রয়েছেন। প্রায় সাত বছর ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা।

আরও পড়ুন

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তখন, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট দেশজ আয়ের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতি ও জীবনমানের অন্য সব সূচকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।

তবে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে কয়েক দিন আগে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটা সংকুচিত হয়েছে। ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে আসন্ন নির্বাচন হবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ নির্বাচন। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে তাঁর নেতৃত্বে শেষ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা ও উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য হলেও আওয়ামী লীগের উচিত হবে বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আপসহীনতা’ শব্দটিকে মহিমান্বিত করা হলেও সারা বিশ্বে রাজনীতিকে ‘সমঝোতার শিল্প’ বা ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ হিসেবে দেখা হয়। সংলাপে বসলেই সমাধান মেলে। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের মাঝেও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন।

বর্তমান সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতি একটা সংলাপের আয়োজন করতে পারেন। নির্বাচন কমিশন সম্ভবত এ মাসের মাঝামাঝি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার আগেই রাষ্ট্রপতির উচিত হবে প্রধান দলগুলোকে নিয়ে সংলাপ আয়োজন করা। সংলাপের মাধ্যমে বর্তমান অচলাবস্থার অবসান হলে দুই দলেরই মান রক্ষা হবে।

  • ড. মো. আবু নাসের চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশনস বিভাগ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, বেকার্সফিল্ড।