ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা নেতারা কেন ক্ষমতা হারাচ্ছেন

বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণ হলো অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনিপ্রথম আলো

গত বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্ষমতাসীনেরা ভোটে হেরে গেছেন। কোথাও কোথাও তাঁদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ আল গেরগাভির যে কথাটি খুবই গুরুত্ব পেয়েছে, সেটি হলো: ‘সরকারের কাজ হলো এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করা, যা নাগরিকদের আশা জাগায়।’

২০২৫ সাল সামনে রেখে রাজনৈতিক নেতাদের বার্তাটি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। শুরু সংকট মোকাবিলার মানসিকতা থেকে সরে এসে একটি সাহসী ও আশাব্যঞ্জক পরিকল্পনা তৈরিতে তাঁদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। গত বছর বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীনদের ভোটে হারিয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলো ছিল নজরকাড়া। 

মার্চ মাসে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট ম্যাকি শাল নির্বাচনের সময় পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এবং পরাজিত হন। জুন মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (যারা তিন দশক ধরে ক্ষমতায় ছিল) প্রথমবারের মতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। একই মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।

জুলাই মাসে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়। অক্টোবর মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মিশেল বার্নিয়ে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন। এর কয়েক দিন পর জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অনাস্থা ভোটে হেরে যান, যা দেশটিতে আগাম নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করে। 

গত বছর কয়েকজন শাসক জনবিক্ষোভের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। আগস্ট মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের বিক্ষোভের মুখে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান। আর গত মাসের শুরুতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ তাঁর সরকার পতনের পর রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্রশ্ন হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা নেতারা কেন ক্ষমতা হারাচ্ছেন? 

এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের প্রতি নাগরিকের আস্থা কমে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একই মতের বা একই ধরনের বিষয়বস্তু গ্রহণকারী মানুষের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়; তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও শক্তিশালী করে এবং ‘সম্মিলন’ নামে পরিচিত মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম সহজ এবং আবেগ উসকে দেওয়া বার্তা চালাচালির জন্য শক্তিশালী মেগাফোন হিসেবে কাজ করে।

প্রক্রিয়াটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং ভীতি সৃষ্টিকারী প্রচারণার জন্য উর্বর ক্ষেত্র করে তোলে। এই মাধ্যম প্রাথমিকভাবে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকদের জন্য সমর্থন বাড়ানোর একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

এর ফলে সোজাসাপটা ও আবেগময় স্লোগান দিয়ে জনগণের মন জয় করতে চাওয়া ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বেশি সুবিধা পান। তবে সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল বলছে, শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমর্থন পাওয়াই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যথেষ্ট নয়। মেক্সিকো, স্পেন, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশে ক্ষমতাসীন বা মূলধারার দলগুলোই জয়ী হয়েছে। যদিও তারা আগের মতো শক্তিশালী নয়, তবু তারা ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নির্বাচনে টিকে থাকতে পেরেছে।

এটা প্রমাণ করে, জনসমর্থন বা রাজনৈতিক সাফল্য পেতে হলে শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা নয়, বরং মাঠপর্যায়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন, কার্যকর নীতি এবং রাজনৈতিক কৌশলের প্রয়োজন হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু এটি মূলধারার রাজনীতির বিকল্প নয়। একটি স্পষ্ট শিক্ষা হলো, সরকারগুলোকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে শেখা উচিত। ভোটারদের উদ্বেগের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে এর শুরুটা হতে পারে। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে নেতাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নাগরিকদের ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা উচিত। ২০২২ সালের একটি গবেষণায় জনতুষ্টিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে বলা হয়েছে, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও সামাজিক খাতে খরচ হ্রাসের মতো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর প্রভাব ফেলে। শুধু স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, রাজনৈতিক নেতাদের উচিত তাদের নাগরিকদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবা। 

অনেক রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকের পরিকল্পনা শুধু বার্ষিক বাজেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং মূলত খরচ কমানোর ওপরেই জোর দেওয়া হয়। তবে বেড়ে যাওয়া খরচ, মহামারি-পরবর্তী কষ্ট এবং নানা কারণে টালমাটাল অবস্থায় পড়া নাগরিকেরা এমন নেতাদের চান যাঁরা তাঁদের আশার আলো দেখাতে পারবেন।

বাজেটের সীমাবদ্ধতাকে জনগণের উন্নত ভবিষ্যৎ তৈরি না করার অজুহাত হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। বাস্তবে সবচেয়ে সাহসী সরকারি উদ্যোগগুলো অনেক সময় অর্থনৈতিক সংকটের সময়ই শুরু হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল’, ব্রিটেনের যুদ্ধোত্তর কল্যাণ রাষ্ট্র, ১৯৫৮-পরবর্তী দুবাইয়ের অবকাঠামোগত উন্নতি এবং ১৯৫৯-পরবর্তী সিঙ্গাপুরের দ্রুত উন্নয়নের কথা বলা যেতে পারে। 

রাজনৈতিক নেতাদের এই সাহসী উদ্যোগগুলো থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে এবং তাদের নাগরিকদের হতাশার মূল কারণগুলো সমাধানে আরও বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে।

নগায়ার উডস ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ