শেষবিদায় হোক শান্তির বিদায়

‘আর কিছু করার নেই, বাড়ি নিয়ে যান।’

এই বাক্য গত ৫২ বছরে কত মানুষ কতবার চিকিৎসকদের কাছ থেকে শুনেছেন, তার হিসাব আমরা রাখিনি। তবে আমাদের চিকিৎসকেরা বাক্যটি যখন উচ্চারণ করেন, তখন বোঝা যায়, তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, রোগী আরোগ্য লাভ করতে পারবেন না এবং তাঁর মৃত্যু হবে। এই মৃত্যু সাত দিন পরে হতে পারে, এক মাস পরে হতে পারে, ছয় মাস বা এক বছর পরেও হতে পারে।

তবে এই মৃত্যুপথযাত্রীর জন্য আমাদের চিকিৎসক, চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত নীতিনির্ধারকদের কি কিছুই করার ছিল না? কিছুই কি করার নেই? একজন মানুষের নির্ঘাত মৃত্যু হবে জেনে সব আশা ছেড়ে দিয়ে তাঁকে এক কোণে ফেলে রাখব, তাঁর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করব, তারপর মারা গেলে দাফন-সৎকার করে দোয়া-প্রার্থনা করব? কিন্তু কোথায় ফেলে রাখব? হাসপাতালে?

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তো একজন জীবন্মৃত মানুষকে রাখতে চায় না। তাহলে কোথায়? মৃত্যুপথযাত্রীর বাড়িতে? একজন মৃত্যুপথযাত্রীর পরিচর্যা কেমন করে করতে হয়, তা কি বাড়ির মানুষেরা জানেন? না, তাঁরা জানেন না। আমরা কেউই জানি না।

ধরুন, একজন মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত এবং তাঁকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই; কিন্তু তাঁর শরীরে অসহনীয় ব্যথা আছে, তাঁর মনেও অনেক কাতরতা আছে। এই ব্যথা ও কাতরতা সহনশীল করা কি সম্ভব নয়?

কেউ মারা যাচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে আমরা সারাক্ষণ বলেই চলেছি, ‘আপনার কিছু হয়নি, আপনি ভালো হয়ে যাবেন।’ আমাদের এই উক্তি হয়তো তিনি বিশ্বাস করছেন; না করলেও হয়তো মেনে নিচ্ছেন। তাঁর কিছু করার নেই, তিনি এখন সহায়হীন। কিন্তু আমরা মিথ্যা কথা বলে তাঁকে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি কি না, তা ভাবছি না।

প্রথমত, তাঁকে মৃত্যুর জন্য তৈরি হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না। প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার অধিকার আছে।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয়ত, মৃত্যুর আগে তাঁর অনেক ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দিচ্ছি না। আমাদের যেমন ইচ্ছা করে, তাঁরও তাঁর পরিবারের সবার চেহারা দেখতে ইচ্ছা করতে পারে, মৃত্যুর আগে সবাইকে কিছু বলার ইচ্ছা হতে পারে, সবার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছা হতে পারে, সবাইকে ‘বিদায়’ বলার ইচ্ছা হতে পারে, সবার সঙ্গে শেষ খাওয়াদাওয়া করার ইচ্ছা হতে পারে।

তৃতীয়ত, তাঁর জীবনহীন শরীরের সৎকার কীভাবে হতে পারে এবং যদি সহায়-সম্পত্তি থেকে থাকে, তাহলে কী কাজে লাগবে, তা নিয়ে তিনি দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। সহায়-সম্পত্তি তো তিনিই গড়েছেন, যারা তাঁর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি, তারা নই।

ব্যথা শরীরের চেয়েও বেশি মনের হতে পারে। আমাদের দেশের ‘মৃত্যু’ শব্দটিই কোনো আলোচনায় নেই। উচ্চারণ করতেই ভয় পাই। কেউ মৃত্যুর কথা বলামাত্রই আমরা বলি, ‘এমন কুকথা বলতে হয় না, বোলো না।’ কিন্তু মৃত্যু কেন ‘কু’ হবে? জন্ম যেমন ‘সু’, মৃত্যুও তেমন ‘সু’ হতে পারে। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে কেন যেন আমরা অস্বীকার করতে চাই। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিনাইয়াল। ভেবেও ভাবি না। মহাপরাক্রমশালী থেকে শুরু করে অতি অসহায়—সবারই মৃত্যু হবে। কেউ হাজার বছর বাঁচেননি এবং কেউ বাঁচবেন না।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মারা যাবেন কত মানুষ? সেই সংখ্যা কি আমরা জানি? বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর কতটা সংগতি আছে এমন মানুষকে পরিচর্যা দেওয়ার? একটা অসমর্থিত পরিসংখ্যানে জানা যায়, আমাদের দেশে মৃত্যু হবে, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। কমবেশিও হতে পারে। তাঁদের আমরা পরিসংখ্যানে আনছি কি না, তা একটা প্রাথমিক পর্যায়ের দায়িত্বশীলতার বিষয়, খুবই বেসিক একটা কাজ।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে মারা যাবেন কত মানুষ? সেই সংখ্যা কি আমরা জানি? বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর কতটা সংগতি আছে এমন মানুষকে পরিচর্যা দেওয়ার? একটা অসমর্থিত পরিসংখ্যানে জানা যায়, আমাদের দেশে মৃত্যু হবে, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। কমবেশিও হতে পারে। তাঁদের আমরা পরিসংখ্যানে আনছি কি না, তা একটা প্রাথমিক পর্যায়ের দায়িত্বশীলতার বিষয়, খুবই বেসিক একটা কাজ।

না হয় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করলাম পরিসংখ্যানে; তারপর তাঁদের জন্য কী করব বা ভাবব, তা একটা বড় প্রশ্ন। আমরা কি এই মানুষগুলোর মৃত্যু সহনীয় করার চেষ্টা করব? আমাদের দেশে কি সেই ব্যবস্থাপনা আছে? নাকি মৃত্যুর সংখ্যা গুনতে গুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই মৃত্যুপথযাত্রীর কষ্ট নিয়ে ভাবি না। এই যন্ত্রণা প্রশমন করার ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে নেই। নেই কেন? মৃত্যু তো শুধু বাংলাদেশের ধনী মানুষের হয় না, গরিব মানুষেরও একই কষ্ট হয়। তাহলে?

আছে, তবে খুব অল্প পরিসরে আছে। অত্যন্ত অপ্রতুল; মহাসমুদ্রের একেবারে এক ফোঁটা পানি। হ্যাঁ, বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ সেবার কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে; কিন্তু সেখানে নামে মাত্র কয়েকজনকে প্রশমনসেবা দেওয়া যায়। আমরা জানি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা প্যালিয়েটিভ সেবার কথা আন্তরিকভাবেই ভাবছেন এবং অন্যান্য সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই সেবার বিস্তার ঘটাতে চাইছেন।

আরও পড়ুন

কাজটা সহজ নয়। সে কারণেই এই বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন, তারপর সিদ্ধান্ত। আমাদের কর্তৃতন্ত্রের সিদ্ধান্ত খুব আয়েশি। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিদের ব্যথা কমাতে হলে আয়েশ কমাতে হবে।

সরকারের কাছে যদি প্যালিয়েটিভ সেবা দেওয়ার মতো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে অর্থ চাইতে পারি। আজকাল একটা বাক্য করপোরেট খাত থেকে প্রায়ই শোনা যাচ্ছে, ‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না।’ পিছিয়ে থাকা মানুষকে নিয়ে অনেক শতাব্দী ধরেই আলোচনা-সম্মেলন চলছে; কিন্তু মানুষ এখনো পিছিয়েই আছেন। সম্মেলনগুলো চলুক, তবে আমরা মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিদের কোনো কোটরে ফেলে না রেখে তাঁদের যন্ত্রণা প্রশমন করার আয়োজন করতে পারি।

এই আয়োজনের কারণ একটাই, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ হঠাৎ মারা যান। আর ৮০ থেকে ৮৫ জনকে ভুগতে হয়। এই ৮৫ জনের জন্যই প্রশমনসেবা জরুরি।

  • ইকরাম কবীর গল্পকার ও যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত