ছবি তুলতে গিয়ে ইশতিয়াক আহমেদের মৃত্যু কোন বার্তা দিয়ে গেল

গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইশতিয়াক আহমেদ নামের একজন আলোকচিত্রী ছবি তুলতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান।ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার কুড়িলে রেললাইনে একটি বাঁক আছে। ওই স্থানে দুটি লাইনে দুটি ট্রেন একসঙ্গে চলতে পারে। ওপরে আছে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া। একই সঙ্গে বাঁক নেওয়া ট্রেন ও কৃষ্ণচূড়ার ছবি দেখতে খুব সুন্দর। এ রকম দৃশ্য দেশে অন্যত্র দেখা যায় না। গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ইশতিয়াক আহমেদ নামের একজন আলোকচিত্রী ওই স্থানে গিয়েছিলেন কৃষ্ণচূড়াসহ চলন্ত ট্রেনের ছবি তুলতে।

ছবি তোলার জন্য ইশতিয়াক আহমেদ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। তাঁর খালাতো ভাইকে বলেছিলেন পেছন থেকে ট্রেন এলে যেন তাঁকে জানান। দুঃখজনক হলো, সামনে থেকে যখন ট্রেন এসেছিল, ইশতিয়াক আহমেদ তখন একাগ্রচিত্তে ছবি তুলছিলেন। সামনে থেকে আসা ট্রেনের শব্দে তিনি পেছনের ট্রেনের শব্দ শুনতে পাননি। তাঁর খালাতো ভাই চিৎকার করে ডাকলেও আগে আসা ট্রেনের শব্দের কারণে সেই ডাকও শুনতে পাননি।

এক ট্রেনের ছবি তুলতে গিয়ে আরেক ট্রেনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ইশতিয়াক আহমেদ। পেছন থেকে আসা ট্রেনের এক যাত্রীর বাঁক নেওয়া স্থানের করা ভিডিওতে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখা গেছে।

ইশতিয়াক আহমেদের এই দুর্ঘটনা থেকে বিশেষত ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু আছে। বন্য পশুপাখি-সাপের ছবি তোলেন যেসব আলোকচিত্রী, তাঁরা সাধারণত ছবি তোলায় বিভোর থাকেন। যেহেতু বন্য পশুপাখি নিজেদের মতো ঘোরাফেরা করে, মানুষ কাছে গেলে তারা দূরে সরে যায়, তাই আলোকচিত্রীরা ছবি তোলায় বেশি মনোযোগী থাকেন।

আলোকচিত্রীরা একটি ভালো ছবির জন্য, ভালো ফ্রেমের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ছবিকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে ব্যস্ত থাকেন। নদীতে যাঁরা পাখির ছবি তুলতে যান, তাঁদের অনেকে ছবি তোলার সময় নৌকায় থাকার কথা ভুলে যান। অনেক সময় এমন হয়, ঝাঁকে থাকা পাখির ছবি তোলার জন্য পেছাতে হয়। কখনো উড়ন্ত ছবি তোলার জন্যও পেছানোর প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে যাঁরা প্রাইম টেলিলেন্স ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেকবার পেছাতে হয়। এই পেছাতে গিয়ে নদীতে পড়ে যাওয়ার অনেক আশঙ্কা থাকে। সবাই যে সাঁতার জানেন, বিষয়টি তেমন নয়। অনেক সময়ে নদীতে স্রোত থাকে, তখন সাঁতার জেনেও রক্ষা হবে না। এভাবে ছবি তোলায় মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে।

অনেকে ছাদ থেকে পাখির ছবি তোলেন। সব ছাদে রেলিং থাকে না। পাখির ছবি তোলার আগে যত সাবধানতার কথাই ভাবা হোক না কেন, একটি ভালো ছবি কিংবা ভালো ফ্রেমের জন্য নিমগ্ন হন আলোকচিত্রীরা। তখন আর সাবধানতার কথা মনে থাকে না। রেলিং ছাড়া ছাদে পাখির ছবি তুলতে যাওয়া একদমই ঠিক নয়। বিদ্যুতের তার থাকে অনেক সময়। পাখির ছবি তোলার সময় বিদ্যুতের তারের বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে।

নদীতে নেমেও পাখির ছবি তুলতে হয়। পাখিকে ‘আই লেভেল’ করতেও অনেকে পানিতে নামেন। বিশেষত নদীর এসব ছবি তোলার সময়ে সাঁতার না জানলে একদমই নামা উচিত নয়। গত বছর একজন আলোকচিত্রী বলছিলেন, রাজশাহীতে পদ্মায় দুর্লভ স্কিমার পাখি দেখে পানিতে নেমে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলেন আর ছবি তুলছিলেন। বুঝতেই পারেননি নদীর অনেক মাঝবরাবর চলে এসেছেন। মাঝবরাবর চলে গেলে খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়।

নদীতে চোরাবালি থাকে। পাখির ছবি তোলার সময় কখনো কখনো চোরাবালির কথা মনেই থাকে না। অনেক আলোকচিত্রী চোরাবালি সম্পর্কে ভালো জানেন না। চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে কীভাবে ভেসে থাকতে হবে কিংবা দ্রুত সেখান থেকে সরে পড়তে হবে, এটি অনেকের জানার বাইরে। এ কারণে চোরাবালির বিষয়েও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। চোরাবালিতে ডুবে মানুষ মারা যাওয়ার অনেক ঘটনা আছে।

শীতকালে সাধারণত নৌকায় করে ছবি তোলা হয়। নদীতে অনেক ডুবোচর থাকে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা অনেক সময় ডুবোচরে প্রবল বেগে ধাক্কা খায়। তখন অনেকে নৌকা থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। অসতর্ক থাকলে পানিতে পড়ে যেতে পারেন যে কেউ।

নদীর চরে রাসেলস ভাইপারসহ অনেক বিষধর সাপ আছে। বিশেষত পদ্মার চরে বিষধর সাপ দেখা যায়। পাখির ছবি তুলতে গেলে সাপ থেকে দূরে থাকা চাই। পাখি এক স্থান থেকে উড়ে আরেকখানে গেলে আলোকচিত্রীরাও ছোটাছুটি করেন। তখন অনেকে আর সাপের কথা মাথায় রাখেন না। এ কারণে সাপে কাটার ভয় থাকে। রাসেলস ভাইপার সাপ একবার কামড়ালে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ারও সময় থাকে না। মৃত্যুর আশঙ্কা তখন বেশি থাকে। পদ্মার চরে ছোটকান পেঁচা ও তিতির পাখির ছবি তোলার সময় আলোকচিত্রীরা অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেন না। এই ছবি তোলার সময় রাসেলস ভাইপারের বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

পানিতে কিংবা বনাঞ্চলে সাপ কিংবা জোঁকের ভয় থাকে। জোঁক রক্ত শুষে নেয়। জীবন বিপন্ন করে না। কিন্তু সাপের কামড়ে জীবন বরবাদ হতে পারে। বনে অনেক পাখি আছে, যেগুলো কেবল বনেই থাকে। এসব পাখির ছবি তোলার জন্য অনেকে সব রকম ঝুঁকি নিয়ে চেষ্টা করেন। এটি ঠিক নয়। কেবল পাখি নয়, বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর ছবি তোলার জন্যও অনেকে মরিয়া হয়ে ওঠেন।

কেউ কেউ তো আছেন, যাঁরা বাঘের ছবি তোলার জন্য বারবার সুন্দরবনে যান। আলোকচিত্রীরা বন্য পশুপাখির ছবি তোলেন, স্বল্পতম সময়ে সবচেয়ে ভালো মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দীর চেষ্টা করেন। ফলে সতকর্তার কথা অনেক সময় ভুলে যান।

অনেকে ছাদ থেকে পাখির ছবি তোলেন। সব ছাদে রেলিং থাকে না। পাখির ছবি তোলার আগে যত সাবধানতার কথাই ভাবা হোক না কেন, একটি ভালো ছবি কিংবা ভালো ফ্রেমের জন্য নিমগ্ন হন আলোকচিত্রীরা। তখন আর সাবধানতার কথা মনে থাকে না। রেলিং ছাড়া ছাদে পাখির ছবি তুলতে যাওয়া একদমই ঠিক নয়। বিদ্যুতের তার থাকে অনেক সময়। পাখির ছবি তোলার সময় বিদ্যুতের তারের বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে।

একটি ভালো ছবির জন্য, একটি ভালো ফ্রেমের জন্য একজন আলোকচিত্রীর ত্যাগ-সাধনা থাকবে। কিছুটা পাগলামি না থাকলে কিংবা ছবি তোলার বিষয়ে আবেগ না থাকলে ভালো ছবি পাওয়া কঠিন। তাই বলে আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

আমাদের বুঝতে হবে, মনে রাখতে হবে, ছবি তুলতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করা যাবে না। ইশতিয়াক আহমেদের মৃত্যু আমাদের সেই বার্তা দেয়। আলোকচিত্রের জগতে ইশতিয়াক আহমেদ তুমুল সম্ভাবনাময় ছিলেন। অসাধারণ ছবি তুলতেন। তাঁর মৃত্যু জীবনের ভীষণ অপচয়। আলোকচিত্রীরা প্রকৃতির গবেষক, পর্যবেক্ষক, সংরক্ষণকারী। এসব আলোকচিত্রী প্রাণ–প্রকৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও বটে। আমরা তাঁদের এমন মৃত্যু দেখতে চাই না।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক