গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর দেশটির ইহুদিদের মধ্যে ইসরায়েলে অভিবাসনের হার দ্রুতগতিতে বেড়েছে। আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট ক্ষোভ এবং বিচারের মুখে পড়তে হয় কি না, সেই ভয়ে রাশিয়ায় বসবাসকারী ১ লাখ ৬৫ হাজার ইহুদির মধ্যে ২০ হাজার ৫০০ জন এরই মধ্যে রাশিয়া ছেড়েছেন।
যুদ্ধের বিরোধিতা করে রাশিয়া থেকে যাঁরা দেশত্যাগ করছেন, ইহুদিরা তাঁদের অন্যতম। ইহুদিদের এ দেশত্যাগ রাশিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়াচ্ছে। এই তিক্ত সম্পর্ক ইসরায়েল ও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় নতুন বিন্যাস তৈরি করছে।
সম্প্রতি রাশিয়ার ইহুদি নেতারা ইউক্রেন যুদ্ধে তাঁদের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। রাশিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান রাব্বি বা যাজক বেরেল লাজার শান্তির আহ্বান জানিয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গত মে মাসে তিনি রাশিয়ার বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজেও অংশ নেন। অন্যদিকে মস্কোতে ইহুদিদের প্রধান রাব্বি পিনচাস গোল্ডস্মিথ সংঘাতের জন্য রাশিয়ার ভূমিকাকে ক্ষমা করা যায় না ঘোষণা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন।
নিকট ইতিহাসের মধ্যে রাশিয়ার ইহুদিরা এখন সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ। ইউক্রেনের সঙ্গে তাঁদের শক্তিশালী বন্ধন রয়েছে। মালদোভা ও বেলারুশের সঙ্গেও তাঁদের বন্ধন দৃঢ়। এর আগে এসব দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যখন অবনতি হয়েছে, তখনই তাঁদের বড় মূল্য দিতে হয়েছে। অনেককে দেশ ছাড়তে হয়েছে। ইতিহাসের একই পুনরাবৃত্তির ভয় তাঁদের মধ্যে আবার দেখা দিয়েছে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করেছেন। অন্যদিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তেহরানে ইরান ও তুরস্কের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এটা মোটেই কাকতালীয় ঘটনা নয়।
যদিও রাশিয়ায় বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদিবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে করে রাশিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে, গত মার্চ মাসে ইউক্রেনীয়দের পক্ষে কথা বলার জন্য ইহুদি সাংবাদিক আলেক্সি ভেনেডিকটভকে জরিমানা করা হয়েছে। কিছু দুর্বৃত্ত তাঁর বাড়ির গেট ভেঙে ফেলে এবং তীব্র ইহুদি ঘৃণার চিহ্ন হিসেবে সেখানে শুয়োরের মাথা রেখে আসে।
রাশিয়ায় অবস্থিত ইসরায়েলের ইহুদি এজেন্সি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে কেউ কেউ। এই সংস্থা ১৯২৯ সাল থেকে ইহুদিদের অভিবাসনের বিষয়টা দেখভাল করে আসছে। এমনকি ইউক্রেনে আগ্রাসনের বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইহুদিবিদ্বেষী যুক্তি দাঁড় করিয়েছে রাশিয়া। মস্কোর পক্ষ থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তারা ইউক্রেনকে নাৎসিবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে চায়। প্রমাণ হিসেবে তারা ইউক্রেনে আজভ ব্যাটালিয়নের দৃষ্টান্ত সামনে নিয়ে আসছে। নাৎসিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইউক্রেনের এই অতি ডানপন্থী বাহিনীটির নিয়ন্ত্রণে ছিল বন্দরনগর মারিউপোল। যদিও ইউক্রেনের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অতি ডানপন্থীরা বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়। ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ধর্মপরিচয়ে তিনি একজন ইহুদি।
গত মার্চ মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ইতালির একটি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অ্যাডলফ হিটলারের ইহুদি বংশে জন্ম হয়েছিল। ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার পেছনেও কারণ রয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ বলেছেন, ইহুদিদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নিচু মাত্রার বর্ণবাদের ঘটনাও ইহুদিবিদ্বেষ বলে বিবেচিত হবে।
ইসরায়েল ও রাশিয়া সম্পর্কে এই ঘটনা বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত হবে। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট যেখানে যুদ্ধ বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, লাপিদের অবস্থান সেখানে অতি কঠোর।
এর আগে এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের বুচায় রুশ বাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক গণহত্যার শিকার হয়েছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়। সে সময় লাপিদ ছিলেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলেন। অন্যদিকে নাফতালি বেনেট কোনো মন্তব্য করেননি তখন। জুলাই মাসে লাপিদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে।
রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনার পারদ যখন চড়ছে, তখন মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাবিন্যাস কেমন হবে, সেটা নিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ইসরায়েল। দৃষ্টান্ত হিসেবে, এখন মস্কো যদি ইসরায়েলের সঙ্গে অসমাপ্ত নিরাপত্তা চুক্তিটি সম্পন্ন করে, তাহলে কী ঘটতে পারে। এই চুক্তি হলে ইসরায়েল তুলনামূলকভাবে আরও স্বাধীনভাবে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি ও হিজবুল্লাহ অবস্থানের ওপর হামলা চালাতে পারবে। সেটা হলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান প্রক্সি যুদ্ধ আরও তীব্র হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এ ছাড়া ভূমধ্যসাগরে নৌঘাঁটি চালু রাখতে চায় রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়লে ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির যে পরিকল্পনা ইসরায়েল নিয়েছে, সেটা বাধাগ্রস্ত করতে পারে রাশিয়া।
দুই দেশের মধ্যে সামরিক রেষারেষির ঘটনা এরই মধ্যে ঘটে গেছে। মে মাসে রাশিয়া সিরিয়াতে ইসরায়েলের একটি বিমান লক্ষ্য করে বিমানবিধ্বংসী এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। জুন মাসে ইসরায়েল সিরিয়ার দামেস্ক বিমানবন্দরে বোমা হামলা করলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানায় রাশিয়া। এরপর জুলাই মাসে সিরিয়ার আকাশসীমায় প্রবেশের কারণে ইসরায়েলের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে ‘সতর্ক গুলি’ ছোড়ে রাশিয়া।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বড় প্রভাব ফেলবে। আগামী নভেম্বর মাসে ইসরায়েলে জাতীয় নির্বাচন। অনেকে এখন এটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন, রাশিয়ার প্রতি কঠোর অবস্থানের কারণে ভোটের মাঠে লাপিদকে কতটা মূল্য চুকাতে হবে। এর মধ্যে এমন সংবাদও এসেছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা শিন-বেট রাশিয়াকে ইসরায়েলের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করার জন্য বলেছে। যদিও ইসরায়েলের সরকার সেই প্রতিবেদন অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাশিয়ার প্রতি লাপিদের এই কঠোর অবস্থানকে নিজের রাজনৈতিক ভাগ্যবদলের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন। নেতানিয়াহু রাশিয়ার প্রেসিডেন্টে ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে গর্ব বোধ করেন। তিনি এখন লাপিদকে ‘রাশিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলে পরিমিত, ভারসাম্যপূর্ণ ও দায়িত্বশীল বন্ধুত্ব’কে বিপদে ফেলার জন্য দোষারোপ করছেন। একই সঙ্গে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা বিপদে ফেলার মতো সংকট তৈরি হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল সফর করেছেন। অন্যদিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তেহরানে ইরান ও তুরস্কের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এটা মোটেই কাকতালীয় ঘটনা নয়।
যুদ্ধের পশ্চাৎপটে নতুন জোট তৈরি হচ্ছে, এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই রাশিয়া ও ইসরায়েলকে সতর্ক করে দিতে হবে যে তাদের তিক্ত সম্পর্কের প্রভাব শুধু নিজেদের সীমানায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।
দিনেশ কামাত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে