একটি শহীদ স্মৃতিসৌধ ও একটি রাস্তার জন্য আর্তনাদ

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী লে. কর্নেল মো. আবদুল কাদির স্মৃতিসৌধছবি : প্রথম আলো

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার আর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সূর্যসন্তান। এই বীর সন্তানদের জন্য আমরা কীই-বা করতে পারি। এই ভাবনা নিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে প্রায় ৫০ বছর পরে যেতে হলো কর্নেল কাদিরের জন্মস্থানে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করা, এই মানুষটির গৌরবময় জীবনকাহিনি সেখানকার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

লেখার শেষের দিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। যে যা-ই বলুক, মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। এর পেছনে যে ইতিহাস আছে, তা জাতি এখনো সঠিকভাবে জানে না। এই সুযোগে সেই ইতিহাস নিয়ে দুয়েকটি কথা বলতে চাই।

বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন যে যদি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়, তাহলে শুধু সামরিক সাহায্য নয়, বরং তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির দরকার রয়েছে। এই যোগাযোগকে আমরা সবাই চিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে। যদিও কোনো একসময় এই মামলাটাকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছিল এবং পাকিস্তানি শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল।

সাবেক ডেপুটি স্পিকার মরহুম কর্নেল শওকত আলী জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন, আগরতলায় যা ঘটেছিল, তা সম্পূর্ণভাবে সত্য ঘটনা, সেটি কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না। সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করার প্রথম বীজ বপন। বাকি ইতিহাস আমাদের জানা আছে।

কর্নেল শওকত আমার পিতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আবদুল কাদিরের বন্ধু। সেই সূত্র ধরে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং আগরতলার বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানতে চাই। কর্নেল শওকত আলী আমাকে সেদিন বলেছিলেন,‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভিত্তিহীন ছিল না, তবে সেটা ষড়যন্ত্র না বরং বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার ব্যাপারে সবচেয়ে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ছিল।

১৯৬৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। এর পরের বছর পাকিস্তানি শাসকেরা গণজাগরণের মুখে বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে।

শহীদ কর্নেল কাদিরের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩-এর শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী হাসনাহেনা কাদিরকে বলেন, তিনি এই বীর সেনা অফিসারকে চিনতেন এবং কেঁদে ফেললেন।

‘আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই ও (কর্নেল কাদির) আমার সঙ্গে দেখা করে এবং জানতে চায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তার মতো সেনা অফিসারদের কী করণীয় আছে। খুবই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মেধাবী অফিসার ছিল।’ এই সাক্ষাতের সময় লেখক উপস্থিত ছিল।

১৯৭১-এর মার্চ মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে কর্নেল কাদির তাঁর সরকারি অফিস ও বাসভবনে (পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান বেতারে ঘোষণা করা হয়, কর্নেল কাদির তাঁর সরকারি অফিসের সবার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর তহবিলে ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন। উল্লেখ্য, তাঁর সরবরাহ করা বিস্ফোরক দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের শোভাপুর সেতুসহ কয়েকটি সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয় (Tale of Millions by Rofiqul Islam, বীর উত্তম, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান এমপি)।

১৭ এপ্রিল, ২০১৪ এশিয়ান টিভিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন যোগ্য ও গুণ বিচারী একজন অফিসার। তাঁর সাহায্য নিয়েই শোভাপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া সফল হয়েছিল।’ সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত লে. জে. এম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কর্নেল কাদির শুধু একজন মেধাবী অফিসারই ছিলেন না, তিনি বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের কাছে রোল মডেল ছিলেন।’ কর্নেল কাদিরের কাছেই প্রথম জানতে পারেন বাংলাদেশে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘তিনি এই নিয়ে তখন প্রচুর কাজ ও চিন্তাভাবনা করছিলেন।’

আনুমানিক মার্চ মাসের শেষের দিকে তিনি যুদ্ধে চলে যান এবং ১৪ বা ১৫ এপ্রিল তিনি ফিরে আসেন সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে একনজর দেখার জন্য। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পরে ২০০৭ সালে লেখক তাঁর কবর খুঁজে পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১১ সালে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পুনরায় দাফন করা হয় কাদিরাবাদ সেনানিবাসে, যা ১৯৮৩ সালে এই বীর শহীদের নামে নামকরণ করা হয়।

কর্নেল কাদির ১৯৭০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি সেনাসদর থেকে জর্ডানের পোস্টিং বাতিল করে প্রায় জোর করেই বদলি নেন। চট্টগ্রামে তিনি তৈল-গ্যাস সংস্থা (বর্তমানে পেট্রোবাংলা) পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। কারণ, তিনি জানতেন স্বাধীনতা বেশি দূরে নয়। আমি জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে তাঁর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করি এবং প্রায় ৫০ বছর পর আমাদের গ্রামের বাড়ি মোস্তফাপুর গ্রাম বদরগঞ্জ উপজেলা, রংপুরে যাই। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম জেনে যে তাঁর নিজের গ্রামের মানুষ জানেন না একজন সূর্যসন্তান তাঁর গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁরা এই বীর মুক্তিযোদ্ধার দেশের জন্য অবদানের কথাও জানেন না এবং তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই আমাদের গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করব।

তিন বছর অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করি, যা শুধু ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি করা বাংলাদেশে প্রথম ঘটনা। কিন্তু এ যেন একটি বিরাট স্বপ্নের বাস্তব রূপ। নাম দেওয়া হয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী লে. কর্নেল মো. আবদুল কাদির স্মৃতিসৌধ। তবে এই ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধাদের নাম স্মৃতিসৌধে তালিকাভুক্ত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধটি তৈরি করি।

স্মৃতিসৌধের দুই পাশে মাল্টা ও ড্রাগন ফলের বাগান, যার ফল বিক্রি করে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্মৃতিসৌধের সামনে দিয়ে একটি সরকারি রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা আছে। কিন্তু নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হওয়ার কারণে আজও সে রাস্তা তৈরি করা হয়নি। সে রাস্তা গত সাত বছরেও তৈরির কাজ শুরু হয়নি।

প্রথমত বলা হলো সেখানে রাস্তার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। সেটা ভুল প্রমাণিত হলো এবং এসি ল্যান্ডের অফিস থেকে কর্মকর্তারা এসে রাস্তাটির জন্য খুঁটি বসিয়ে যান। এরপর শুধু হবে আর হচ্ছের মধ্যে আবর্তিত রাস্তার কাজ শুরু হওয়ার ব্যাপারটি। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এহসানুল হক চৌধুরী (ডিউক) বহুবার কথা দেওয়ার পরেও এই রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয়নি। আমি আশান্বিত যে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হওয়াতে এই কাজটি দ্রুতগতিতে শুরু হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুর অফিসে ফাইলটি ঘোরাঘুরি করছে। কারণ সংলগ্ন চিকলী নদীর দুই পাশে বাঁধ দিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও এই রাস্তার জন্য কেন আমাদের আর্তনাদ করতে হচ্ছে? যে স্মৃতিসৌধকে বাংলাদেশের একটি অনন্য স্থাপনা বলা যেতে পারে, সেই স্মৃতিসৌধের জন্য মনে হচ্ছে বিন্দুমাত্র সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন সরকারি দলীয় লোকেরা এবং স্থানীয় কর্মকর্তারা। উল্লেখ করতে চাই, স্থাপনাটির চিরস্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেনাপ্রধানকে আমি একটি আবেদন করেছি এবং সেটার উত্তরের অপেক্ষায় আছি।

শেষ কথা: এ ঘটনা বিশেষভাবে আমাকে পীড়া দেয়। কত মেগা প্রজেক্ট আর কত এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে কিন্তু একটি রাস্তা তৈরি না করে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অশ্রদ্ধা করা হচ্ছে, প্রশ্নটা করতেই পারি। এই প্রশ্নের উত্তর কি পাব নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে আর্তনাদ করতে হবে? কারণ, তিনি সেই ব্যক্তি, যাঁর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সূর্যসন্তান। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কাদিরাবাদ সেনানিবাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্নেল কাদিরের পুনর্দাফনের ব্যবস্থা করে দেন ২০১১ সালে।

 এদিকে দুই সামরিক কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মরহুম মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া এবং অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, কাদিরাবাদ সেনানিবাস হওয়াতে তাঁরা খুশি। তবে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য সরকারের আরও উদার হওয়া প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতা পদকের জন্য তাঁর নাম মনোনয়ন দেওয়া হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, কমিটির সূত্রমতে, কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ ও তথ্যাবলি না থাকায় তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বলেছিলেন, তাঁর টেবিল পর্যন্ত ফাইলটা পৌঁছায়নি। আশা করি সেনাবাহিনীর তরফ থেকে নতুন করে প্রস্তাবটি পাঠানো হবে ২০২৫ সালের জন্য।  

  • নাদীম কাদির
    জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক
    (রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায়/ জাগৃতি প্রকাশনী)