জুলাই গণ-অভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা তরুণ নেতাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা দেশের মানুষ একনামে চিনলেও তাঁদের অধিকাংশকেই দেশের প্রান্তিক জনগণ কখনো সামনাসামনি দেখার সুযোগ পায়নি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বিপুল জনসমাগমের মধ্য দিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরুর পর গত কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও দলটির কার্যক্রম ছিল কেবল রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক।
এ নিয়ে এনসিপি নিয়ে নানা সমালোচনা ওঠে, দলটি তৃণমূলের জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। প্রান্তিক মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের কথা শোনা—এ ছাড়া একটি রাজনৈতিক দল দাঁড়াবে কী করে?
তবে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পেলাম সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে জনসংযোগ ও পথসভা শুরু করেছেন দলটির নেতারা। এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে খোলা পিকআপে চেপে রোদ–বৃষ্টি উপেক্ষা করে দলের নেতা–কর্মীরা চট্টগ্রামের সব কটি উপজেলায় পথসভা করেছেন। সঙ্গে ছিলেন দলের সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা।
স্কুল, বাজার-ঘাটে মানুষের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁরা এতখানিই মিশতে পেরেছেন যে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে মানুষ প্রেসক্রিপশন ফাইল হাতে নিয়ে এসেছে ডা. তাসনিম জারাকে দেখাতে।
সাবেক উপদেষ্টা এবং দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে মোহাম্মদপুর থেকে তাঁর প্রথম জনসংযোগ শুরু করেছেন। হাঁটুপানি ভেঙে অবহেলিত জেনেভা ক্যাম্প পর্যন্ত গণসংযোগ করেছেন তিনি। দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম তাঁর সাংগঠনিক টিমসহ সফর করেছেন নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরের প্রতিটি উপজেলা।
ঢাকা ছেড়ে এনসিপির এই জনযাত্রা দলের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। ঐতিহাসিকভাবেই কোনো রাজনৈতিক প্রান্তিক জনসাধারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়নি। ১৯৩৫ সালের আগস্টে কার্যকর হয় ভারত শাসন আইন। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইনে ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলোতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু ১৯৩৬ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৩৭ সালের শুরুর সময়টিতে ভারতব্যাপী রাজনৈতিক সফরে বের হন।
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্রনেতাদের প্রতি দেশের জনগণের যে অভূতপূর্ব আস্থা ও ভরসা তৈরি হয়েছে, সে আস্থা ও ভরসার প্রতি সম্মান রেখে এনসিপি নেতাদের উচিত, জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যাওয়া। বাংলামোটর থেকে বটতলায় জড়ো হওয়া কৃষক আর মজুরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তাঁদেরকে এগোতে হবে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অনুযোগ, আবদার শুনতে হবে।
উপমহাদেশের রাজনীতির অন্যতম এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে সেই সফরের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করেছেন। এ সফরের পুরো সময় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একের পর এক জনসভা ও প্রচার সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন।
নেহরু লিখেছেন, তিনি গাড়িতে, রেলপথে, বিমানে এ যাত্রা করলেও কখনো কখনো স্টিমার, বাইসাইকেল চেপে, প্যাডেল বোট, ডিঙি, উট, ঘোড়া এমনকি হাতিতে চড়েও অনেক জায়গায় তাঁকে যেতে হয়েছে। পায়েও হেঁটেছেন অনেক। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কর্ণাটক সফরকালে তিনি কেবল এক দিনে ২৩ ঘণ্টা জনসভা ও প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন এবং পাড়ি দিয়েছিলেন ৪১৫ মাইল পথ।
সাড়ে পাঁচ কোটি সদস্যের প্রাচীন ও অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর প্রপিতামহের লেখা বই নিশ্চয়ই পড়েছিলেন। কিন্তু দুই দশকের রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিকে তিনি তা উপেক্ষা করেছেন। ভোটের সময় রুটিন জনসভা, সংসদীয় বিতর্ক আর টিভি উপস্থিতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন তিনি। সেই তিনিই গত লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে কংগ্রেসকে বাঁচাতে প্রায় ১৪৪ দিনের বেশি পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী থেকে ভারত-জোড়ো যাত্রা শুরু করে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পৌঁছেছিলেন শ্রীনগর।
ব্যাপক আলোড়ন তোলা সেই যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব ছিল মণিপুর থেকে ‘ন্যায় যাত্রা’ নামে আরও একটি রাজনৈতিক সফর। এবারে ১৪টি রাজ্য পাড়ি দেন। এ যাত্রা অবশ্য পদযাত্রা ছিল না। কিন্তু নিভু নিভু কংগ্রেসের উত্থানে রাহুল গান্ধীর এই দুই সফর নতুন জাগরণ আনে। ভারত জোড়ো যাত্রা–পরবর্তী ২০২৩ কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানার নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপিকে হারাতে সক্ষম না হলেও ৯৯টি আসন জিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গত এক দশকে প্রথমবারের মতো ভারতে বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধীর এই দুই যাত্রার পথে থাকা আসনগুলোর মধ্যে ৪১টি তাঁর দল ও জোট জিততে সক্ষম হয়।
রাজনীতির ভিত্তি হয়তো রাজধানী হতে পারে। কিন্তু যেকোনো রাজনীতির প্রাণ ও ভিত মূলত সাধারণ মানুষের বসতি ও গ্রামগুলো। এর অন্যতম উদাহরণ অবিভক্ত বাংলার খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম। তাঁর রচিত ‘আমার জীবন ও বিভাগপূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি’ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন:
‘ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ প্রকৃত অর্থে ঢাকা নওয়াব পরিবারের প্রধান আবাসস্থল আহসান মনজিলের চার দেওয়ালের গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আহসান মনজিলের খাজাদের পকেটভুক্ত ছিল।’
১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগ কাউন্সিল সভায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। এরপর তিনি সারা বাংলা অঞ্চলের প্রতিটি এলাকা সফর করে সংগঠনকে শক্তিশালী করে তোলেন। এক বছরের মধ্যেই এ অঞ্চলে মুসলিম লীগের পাঁচ লাখ চাঁদাদাতা সদস্য নিবন্ধিত হন। যাঁরা প্রত্যেকেই দুই আনা করে চাঁদা দিতেন। সে বছর প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কেবল সদস্য পদের ফি বাবদ নগদ ১৫ হাজার টাকা সংগ্রহে সমর্থ হয়।
গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্রনেতাদের প্রতি দেশের জনগণের যে অভূতপূর্ব আস্থা ও ভরসা তৈরি হয়েছে, সে আস্থা ও ভরসার প্রতি সম্মান রেখে এনসিপি নেতাদের উচিত, জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যাওয়া। বাংলামোটর থেকে বটতলায় জড়ো হওয়া কৃষক আর মজুরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তাঁদেরকে এগোতে হবে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, অনুযোগ, আবদার শুনতে হবে।
ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে চাঁদাবাজি এবং অলিগার্কদের যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ তা ভেঙে দলকে দুই আনা কিংবা দুই টাকার লাখ লাখ চাঁদাদাতা সদস্যনির্ভর করতে হবে। দলের অর্থনৈতিক ভিত্তি হতে হবে সদস্য ও শুভানুধ্যায়ী প্রদেয় গণচাঁদা অর্থাৎ ক্রাউড ফান্ডিং। জনসম্পৃক্ততার মধ্য দিয়েই জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–কে বিকশিত করতে হবে।
তরুণেরা সংস্কারের যে আওয়াজ নিয়ে মাঠে নেমেছেন, তার সর্বপ্রথম প্রতিফলন ঘটতে হবে তাদের দলীয় রাজনীতির মধ্য দিয়েই। বাংলাদেশের স্বার্থেই দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অত্যাবশ্যক।
আরজু আহমাদ কেন্দ্রীয় সদস্য, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)