প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে আরও বড় অবদান রাখতে চান, কিন্তু...

‘স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানুষ তারে? পশু সেইজন’—স্কুলজীবনে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে সম্ভবত আমাদের সবাইকেই বাক্যটির ভাবসম্প্রসারণ করতে হয়েছে। তারপর আছে, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা?’ আছে সংস্কৃত শ্লোক: ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’, অর্থাৎ জননী ও জন্মভূমি স্বর্গের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। পাঠ্যপুস্তক এভাবেই আমাদের দেশপ্রেমের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

দেশের বাইরে আসার পর দেশপ্রেম বেড়ে যাওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, একটি উন্নত দেশের তুলনায় নিজের দেশ যে কতটা পিছিয়ে আছে, তার লক্ষণগুলো পরিষ্কার ফুটে ওঠে। ভাঙা রাস্তার ধুলাবালু, সর্বত্র ছড়ানো-ছিটানো ময়লা, বাতাসের ধোঁয়া, পরিবহনের জীর্ণ দশা, দখল হয়ে যাওয়া নদীপাড়, বর্জ্য পদার্থে ভরা নদীর জল—এ রকম ভৌত পরিবেশ ছাড়াও আরও মনে পড়ে অফিসে, আদালতে, বিদ্যালয়ে, হাসপাতালে ঘুষ ও দুর্নীতির কথা। উন্নত দেশটির সবকিছুর প্রতি যখন তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তখন মনে হয়, ‘আহা! আমার দেশটাও যদি এ রকম হতো!’ আমাদের দেশে আমাদের চারপাশে অনেক গরিব মানুষের বসবাস, আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও অনেকে গরিব থাকেন। তাঁদের জন্যও মনটা খুব কাঁদে। এ জন্যই মানুষ শিকড়ের টান সহজে ছিন্ন করতে পারে না।

আরও পড়ুন

আবার ‘বি আ রোমান হোয়েন ইউ আর ইন রোম’, অর্থাৎ তোমার বসবাস যখন রোমে, তোমারও উচিত একজন রোমান হয়ে ওঠা। কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। যে দেশে আমার অবস্থান, সেই দেশের আইন, জাতীয় চেতনা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত—এমনকি সমাজের রীতিনীতি, প্রথা, মূল্যবোধ ধারণ করা দরকার, কিন্তু স্বদেশ-চেতনা ও জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে নয়। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘আমি দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিশ্বকে ভালোবাসি।’ বস্তুত, ভারতীয় উপমহাদেশে রবীন্দ্রনাথের মতো, আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা, প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সেতুবন্ধের ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আদান-প্রদানের কথা এমন উচ্চ কণ্ঠে আর কেউ বলেননি।

যে দেশে আমার বসবাস, আমি যদি সেই দেশেরই একজন হয়ে উঠি, তাহলে অনেক উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব। সে জন্য অদক্ষ শ্রমিক, ছাত্র, এমনকি শিক্ষিত জনকেও দেওয়া দরকার প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ গন্তব্য দেশের ও সমাজের আইনকানুন, রীতিনীতি, প্রথা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সম্পর্কে। যেখানে-সেখানে ময়লা না ফেলা, প্রকাশ্যে থুতু না ফেলা, নিচু স্বরে কথা বলা, অন্যকে পথ ছেড়ে দরজা টেনে ধরা, আড়ালে গিয়ে নাক পরিষ্কার করা, পেপার ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া ইত্যাদি সব ধরনের সৌজন্য বোধের শিক্ষা বহির্গমন নাগরিককে দিতে হবে। তাহলে বিদেশে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, যার সুফল হবে সুদূরপ্রসারী। প্রশিক্ষণের জন্য গঠন করতে হবে পররাষ্ট্র, শ্রম ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কার্যকর টিম।

কানাডার মতো বাংলাদেশের পক্ষেও একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সম্ভব। শিক্ষাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। সে জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ জরুরি। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃতিমান মানুষ তৈরি করা। একজন সংস্কৃতিমান মানুষ সমন্বিত জীবনচেতনা ধারণ করেন। তিনি জানেন, তাঁর কল্যাণ নির্ভর করে অন্যের কল্যাণের ওপর। তিনি বিশ্বাস করেন, সহযোগিতা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ বৃদ্ধি করে এবং বৃদ্ধি হলে, তার ভাগ তিনি নিজেও পাবেন

প্রবাসীদের দেশপ্রেম এবং স্বদেশের জন্য কিছু একটা করার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ দেখতে পেলাম সেদিন কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে উত্তর আমেরিকার বাংলাদেশিদের এক বিশাল সমাবেশে গিয়ে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা) এক এক বছর উত্তর আমেরিকার এক এক শহরে এ রকম সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। সেপ্টেম্বরের ১, ২ ও ৩ তারিখে মন্ট্রিয়ল শহরে এবারে ছিল ফোবানার ৩৭তম সমাবেশ।

তিন দিনব্যাপী এই কনভেনশনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল সেমিনার ও সাহিত্যের আসর। বিষয়টি আয়োজকদের বুদ্ধিমত্তার ও মননশীলতার ইঙ্গিতবহ। এ থেকে বোঝা যায়, তাঁরা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেন। খারাপ কাজের নিন্দা ও ভালো কাজের প্রশংসা সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যই আয়োজকদের বিশাল টিমের মধ্য থেকে অন্তত কয়েকটি নাম আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। ফোবানার কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারপারসন আতিকুর রহমান ও এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি ড. রফিক খান। মন্ট্রিয়লে এ বছরের কনভেনশনের চেয়ারম্যান শামিমুল হাসান, কনভেনর দেওয়ান মনিরুজ্জামান, মেম্বার সেক্রেটারি হাফিজুর রহমান।

আরও পড়ুন

সেমিনারটি আয়োজনের সার্বিক দায়িত্ব নেন অণুজীব বিজ্ঞানী ড. শোয়েব সাঈদ, যিনি কানাডাভিত্তিক একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ডিরেক্টর। কনভেনশন কর্তৃপক্ষ শেরাটনের মতো বিলাসবহুল হোটেলের একটি কক্ষ ভাড়া করেন শুধু সেমিনার ও সাহিত্যের আড্ডার জন্য। তিন ঘণ্টা বরাদ্দ ছিল সেমিনারের জন্য। ড. শোয়েব চারটি পর্বে ভাগ করে চারটি ভিন্ন বিষয়ে চারজন মুখ্য আলোচক নিমন্ত্রণ করেন।

প্রথম পর্বে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয় ‘শিক্ষাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি: বাংলাদেশ-কানাডার ওপর একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ’ বিষয়ে মুখ্য আলোচনা উপস্থাপন করতে। এই পর্বে চেয়ারের দায়িত্বে ছিলেন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরের তিনটি পর্বে মুখ্য আলোচক ছিলেন যথাক্রমে ম্যাকগিলের ইতিহাসের অধ্যাপক শুভ বসু, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাংক্ট অধ্যাপক এ কে এম আলমগীর ও টরন্টো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শাফি ভূঁইয়া। পর্বগুলোতে চেয়ার ছিলেন যথাক্রমে মেজর (অব.) দিদার হুসেইন, অধ্যাপক ওয়াইজ আহমেদ ও হাসান আমজাদ খান। সেমিনারটি পরিচালনা করেন ড. শোয়েব।

আমি আমার বক্তব্যে বলেছি, কানাডার মতো বাংলাদেশের পক্ষেও একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সম্ভব। শিক্ষাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি। সে জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ জরুরি। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃতিমান মানুষ তৈরি করা। একজন সংস্কৃতিমান মানুষ সমন্বিত জীবনচেতনা ধারণ করেন। তিনি জানেন, তাঁর কল্যাণ নির্ভর করে অন্যের কল্যাণের ওপর। তিনি বিশ্বাস করেন, সহযোগিতা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ বৃদ্ধি করে এবং বৃদ্ধি হলে, তার ভাগ তিনি নিজেও পাবেন।

শিক্ষার আরেকটা প্রধান উদ্দেশ্য, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা, নিজের জীবনধারা নিজেই ঠিক করার অধিকার বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি করে, মেধা সৃষ্টি করে, যা সীমিত সম্পদ থেকে উৎপাদন বাড়ানোর অপরিহার্য শর্ত। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সমস্যা সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে, যা নৈতিকতা ও সমন্বিত জীবনচেতনার শিক্ষা দেয়। শিক্ষাব্যবস্থার এসব বৈশিষ্ট্য কানাডা অর্জন করেছে বলেই তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছাতে পেরেছে।

আরও পড়ুন

আমি আমার বক্তৃতায় বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় শামিল হতে প্রবাসীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি এবং একটি চমৎকার উপায় বাতলে দিয়েছি। কানাডায় বসবাসরত নাগরিকেরা, যাঁদের বিনিয়োগে আগ্রহ আছে, তাঁদের সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে বাংলাদেশে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ, বাংলাদেশ-কানাডা ব্যবসা ইত্যাদি সম্ভব। এভাবে দেশের অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জিডিপি বৃদ্ধি পাবে এবং সংশ্লিষ্ট সবার জীবনের উল্লম্ফন ঘটবে, দেশের জন্য কিছু করতে না পারার অবসাদও দূর হবে।

বাংলাদেশি কানাডীয়রা যদি এ রকম কনসোর্টিয়াম গঠন করে, অর্থনীতির লোক হিসেবে আমি সব ধরনের পরামর্শ দিতে এক পায়ে খাড়া। আমাদের অনুসরণ করে অন্যান্য দেশের বিনিয়োগে উৎসাহী বাঙালি ও বাঙালি অর্থনীতিবিদেরাও এগিয়ে আসবেন। এ রকম বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে অন্য এক উচ্চতায়।

এবারের মন্ট্রিয়ল কনভেনশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অনেককে পুরস্কৃত করল। এভাবে গুণীজনের অথবা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার স্বীকৃতি সমাজের মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহ জোগাবে। সবচেয়ে ভালো লাগল যখন দেখলাম, নারীর ক্ষমতায়নের জন্যও পুরস্কারের ব্যবস্থা ছিল। আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী যে মনোভাব এসব মানুষের মধ্যে দেখলাম, তা নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্নটা আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর নতুন করে স্থাপিত হলো।

শেষ রাতে ছিল সাবিনা ইয়াসমীনের গানের আসর। গানের ফাঁকে ফাঁকে শ্রোতাদের মধ্য থেকে মুহুর্মুহু অনুরোধ আসতে লাগল, ‘সব কটি জানালা খুলে দাও না’ গাইবার জন্য। সাবিনা যখন উচ্চারণ করলেন, ‘যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ...চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রুটুকু/ এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই’, তখন অনেকেই অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। এই দৃশ্য দেখে আমিও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। আর শেষ গানে যখন উচ্চারিত হলো, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, তখন দেখলাম একঝাঁক বাঙালির দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা। এই ক্ষুদ্র জীবনে এমন দিন কি আর আসবে? আমি জানি না, কিন্তু আমার বাঙালি বিশ্বে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং টিকে থাকবে অনন্তকাল, সেটা জানি।

  • ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]