সমতার সমাজ থেকে আমরা কেন দূরে সরে এসেছি

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎজ তাঁর গ্রেট ডিভাইড গ্রন্থে অসমতাকে সমাজে বিভক্তির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমেরিকান সমাজে অসমতার বহুমাত্রিকতা ও প্রভাব নিয়ে এ গ্রন্থে তিনি গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আমেরিকান সমাজে কি এমন কেউ আছেন, যিনি এ মহাবিভক্তি অস্বীকার করতে পারেন? অক্সফামের ২০১৬-এর তথ্য ব্যবহার করে স্টিগলিজ উল্লেখ করেন, পৃথিবীর এক ভাগ ধনীদের হাতে অর্ধেক সম্পদ আর ৯৯ ভাগের হাতে বাকি অর্ধেক সম্পদ।

বিশ্বব্যাপী সম্পদ ও আয়কেন্দ্রিক বিভক্তি বাড়ছে। ইউনাইটেড নেশনস্ কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউএনসিটিএডি) দ্য মানি ফেসেস অব ইকুয়ালিটি শিরোনামে ২০১৩-তে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অসমতা বৃদ্ধির পেছনে আয়বৈষম্য এবং সম্পদের কেন্দ্রীভূত প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হয়। আয় ও সম্পদভিত্তিক অসমতার একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে—ওয়ার্ল্ড ইনইকুইলিটি রিপোর্ট ২০২২-এ । বলার অপেক্ষা রাখে না, পৃথিবীর সম্পদ ক্রমে জায়ান্ট করপোরেশনগুলোর কাছে জমা হচ্ছে।

বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্রণীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, ১৯৬৬ সালে প্রণীত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত সনদে সব মানুষের সমান অধিকার স্বীকার করা হয়েছে।

কাগজ-কলমে সমান অধিকার স্বীকার করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। সম্পদ ও আয়কেন্দ্রিক অসমতা অগ্রগতির ওপর পেরেক ঠুকছে। সম্পদ ও আয়ে মানুষের প্রবেশগম্যতা ও অধিকার ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য সামাজিক সূচকের ওপর। জোসেফ ই স্টিগলিৎজ আমেরিকান সমাজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সম্পদ ও আয়বৈষম্যের কারণে গরিব শিশুরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জোসেফ ই স্টিগলিৎজ যুক্তি দিয়ে বলেন, অসমতাকে একটি চয়েস (বাছাই) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ অসমতার নীতি রাষ্ট্রপরিচালনায় নিয়ামক হয়ে উঠছে। নীতিনির্ধারকেরা সমতার কথা বলছেন, কিন্তু অসমতা কমিয়ে আনতে প্রণীত নীতিকাঠামোর অকার্যকারিতা প্রমাণিত হচ্ছে।

অ্যারিস্টটল মনে করতেন, অসমতার সবচেয়ে ঘৃণ্য ধরন হলো অসম বিষয় সম হিসেবে দেখানোর চেষ্টা। যেমন মোট দেশজ উৎপাদন অগ্রগতির গড় হিসাবে হতদরিদ্র হাজার হাজার মানুষের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন থাকে কি? ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলার বলে উল্লেখ করেছিলেন। বাস্তবে হয়তো সিংহভাগ মানুষের এক টাকাও আয় বাড়েনি; বরং ক্ষেত্রবিশেষে কমেছে।

সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এগলেটেরিয়ান বা সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ আজ যোজন যোজন দূরে। স্বাধীনতা-পূর্ব ২২ পরিবারের জায়গায় আজ হয়তো ২২ শ পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না।

অর্থনীতির গড় হিসাব দিয়ে জনজীবন বোঝা যায় না। কিন্তু লোকরঞ্জনবাদী সরকারগুলো গড় হিসাব দিয়ে জাতীয় অগ্রগতির এক স্বস্তিদায়ক অনুভূতি তৈরি করতে চায়। এখন গড় হিসাবের জামানা। সম্পদ, আয়, ব্যয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব উন্নয়নসূচকের গড় হিসাব কষা হচ্ছে। কিন্তু সেই গড় হিসাবের মধ্যে জনমানুষের মুখ না-ও থাকতে পারে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) ১০ নম্বর অভীষ্টে অসমতা কমিয়ে আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। ১০ নম্বর অভীষ্টের আওতায় ১৩টি লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে; যার অন্যতম হলো আয় অসমতা, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, সমান সুযোগ সৃষ্টি ও বৈষম্য বিলোপ ও সমতা অর্জনের জন্য নীতিকাঠামো প্রণয়ন।

ন্যায্য, সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্ণামের অঙ্গীকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাংবিধানেও উল্লেখ করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫), রূপকল্প ২০৪১-এ উন্নত বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। এসব নীতিকাঠামো সত্ত্বেও দেশে সম্পদের মালিকানা ও আয়বৈষম্য কমছে না। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বৃত্তায়ন বাড়ছে। নীতিকাঠামো সামষ্টিক স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে সুরক্ষা দিতে অধিকতর কার্যকর প্রতীয়মান হচ্ছে।

ধনী আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হচ্ছে। সামাজিক সূচক যেমন প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জেন্ডার সমতায় অগ্রগতি সন্তোষজনক হলেও সম্পদ ও আয়বৈষম্যে বিস্তর ফারাক থেকে যাচ্ছে। হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স ট্রেন্ড ইন বাংলাদেশে (১৯৯০-২০২১) উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১০ সালে দেশে আর্থিক অসমতার হার ছিল শূন্য দশমিক ৪৫৬, যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৮২-তে।

অসমতার রয়েছে বহুমাত্রিক অভিঘাত। এর মধ্যে অন্যতম হলো নাগরিক অস্থিরতা ও বঞ্চনাবোধ। নাগরিক বঞ্চনাবোধ একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে প্রধানতম অন্তরায়। অসমতার আরেকটি বিশেষ দিক হলো অসমতা আরও অসমতা তৈরি করে। কারণ, সম্পদ ও অর্থের রয়েছে সর্বগ্রাসী প্রভাব। ক্ষমতা, সুবিধা, সুখ, মর্যাদা আসে সম্পদ ও অর্থের হাত ধরে, যা সমাজের পরতে পরতে অন্যায্যতা তৈরি করে। বৈষম্য বাড়তে থাকলে অন্যায্যতার শিকল ভাঙা কঠিন হয়ে পড়ে।

মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ গড়তে অসমতা দূর করতে হবে। কারণ, অসমতা এক নিঃস্বকরণ তৎপরতা। সংখ্যাগুরুকে নিঃস্ব করে গুটিকয়েককে মানুষের তরতরিয়ে ওঠা। এমন পরিস্থিতিতে অর্থবিত্ত আবারও সমর্পিত হয় ওই বিত্তবানদের কাছে।
মজার ব্যাপার হলো সম্পদ ও অর্থ নীরবতার সূচক নয়। দেখানোর উপলক্ষমাত্র। যার অর্থ ও সম্পদ রয়েছে, তিনি ক্ষমতাবান, তিনি তা দেখাতে পারদর্শীও বটে।

জনপরিসরের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পদ ও আয়কেন্দ্রিক বিভক্তি সহজেই চোখে পড়ে। এ বিভক্তি কারও অচেনা নয়, এ সবার চিরচেনা শক্র।

নীতিবাদী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একটি নৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন, আমার ধনী হওয়ার কী অধিকার রয়েছে? সমৃদ্ধ জীবনযাপনের কী অধিকার রয়েছে? যেখানে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ রয়েছে দারিদ্র্য ও অসমতার মধ্যে।

সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম স্বপ্ন ছিল এগলেটেরিয়ান বা সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশ আজ যোজন যোজন দূরে। স্বাধীনতা-পূর্ব ২২ পরিবারের জায়গায় আজ হয়তো ২২ শ পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না।

দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া সম্পদ ও আয়কেন্দ্রিক অসমতা কমানো সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষানির্ভর সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে অসমতা দূর করতেই হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তা প্রতিফলিত হয়েছে,  ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য...।’

  • খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগবিশেষজ্ঞ