দেশবন্দনা একটি স্বাভাবিক প্রবণতা ও ক্রিয়া। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু একটি উপনিবেশে বা উপনিবেশ-উত্তর সমাজে আবেগতাড়িত হয়ে মানুষ দেশকে পূজা করে। সেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবে, এই বুঝি পরাধীনতার শিকল আরও শক্ত হলো কিংবা নতুন করে শিকল পরানোর পাঁয়তারা চলছে। সে জন্য আমরা নানা মোটিফ বা উপমা দিয়ে দেশের যা আছে, তার সব ভালো এবং যা কিছু বিদেশি, তা-ই খারাপ ও পরিত্যাজ্য—এমন একটা আবহ ও উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করি।
উনিশ শতকের বাঙালি কবি ও সম্বাদ প্রভাকর-এর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) তাঁর ‘স্বদেশ’ কবিতায় লিখেছেন:
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে,
দেখ দেশবাসীগণে,
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ স্নেহ করি,
দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া॥
এই কথাগুলোর সহজ অর্থ হলো, বিদেশের দেবতা কিংবা নেতার চেয়ে দেশের ‘কুকুর’ও বরণীয়। এখানে আক্ষেপের সুর স্পষ্ট। আমরা আমাদের দেশের যোগ্য লোককে সম্মান দিই না।
বাঙালি একটি পুরোনো জাতি হলেও রাষ্ট্র হিসেবে অপেক্ষাকৃত নবীন। কূটনীতির অ-আ-ক-খ শিখতে সময় লাগছে। তারপরও মাঝেমধ্যে ইগো আর কমনসেন্সের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়। ফলে নিমেষেই বন্ধু শত্রু হয়ে যায়। রাষ্ট্রের বা নাগরিকের স্বার্থের চেয়ে আমরা কখনো–সখনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের গুরুত্ব দিই বেশি। ফলে গোলমাল বাধে। একপর্যায়ে এসে লেজেগোবরে হয়ে যায়। সামাল দেওয়া যায় না।
আজকের গ্লোবাল ভিলেজে এসব অতি–জাতিবাদী কথা তেমন চলে না। ডিজিটাল যুগে দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। কোনো দেশ একা একা চলতে পারে না। অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য দরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে লেনদেন, তাদের সহযোগিতা। আর এ জন্যই আমরা বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামের সদস্য হতে চাই এবং হই। এ জন্য কখনো দৌড়াই জোহানেসবার্গে, কখনো নয়াদিল্লিতে।
মনে আছে, ষাটের দশকের শুরুর দিকে ইন্দোনেশিয়ার ‘জাতির পিতা’ সুকর্ণ নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে পরাশক্তিগুলোর বাইরে যে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও বলয় তৈরি হয়েছিল, তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এ জোটের জন্ম হয়েছিল। তাঁর কমিউনিস্টঘেঁষা নীতির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার টানাপোড়েন তৈরি হয়। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে জাতিসংঘ থেকে বেরিয়ে আসেন। আয়োজন করেন ‘কনফারেন্স অব দ্য নিউলি ইমার্জিং কান্ট্রিজ’।
দেশটি প্রায় একঘরে হয়ে পড়েছিল। একটানা ২২ বছর রাষ্ট্রপতি থাকার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানে সুকর্ণ ক্ষমতা হারান। বেশ কয়েক বছর পর ইন্দোনেশিয়া আবেদন করে জাতিসংঘের সদস্যপদ ফিরে পায়। কিন্তু এই কয়েক বছরে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের জনবহুল দেশটি অনেক পিছিয়ে পড়ে।
কার ওপর ভরসা করবে আওয়ামী লীগ
ইন্দোনেশিয়া এখন আসিয়ান জোটের দুর্বল সদস্য। অর্থনৈতিকভাবে তাকে অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রনায়কের ব্যক্তিগত ইগো একটি দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য যে কত ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে, ইন্দোনেশিয়া তার একটি উদাহরণ।
কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নেতারা কখনো দেশকে স্বেচ্ছানির্বাসনে নিতে চান না। ১৯৭২ সালে মার্কিন মদদে জাতিসংঘের সদস্য হয়ে গণচীন এটি বুঝিয়ে দিয়েছে।
বাঙালি একটি পুরোনো জাতি হলেও রাষ্ট্র হিসেবে অপেক্ষাকৃত নবীন। কূটনীতির অ-আ-ক-খ শিখতে সময় লাগছে। তারপরও মাঝেমধ্যে ইগো আর কমনসেন্সের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে যায়। ফলে নিমেষেই বন্ধু শত্রু হয়ে যায়। রাষ্ট্রের বা নাগরিকের স্বার্থের চেয়ে আমরা কখনো–সখনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের গুরুত্ব দিই বেশি। ফলে গোলমাল বাধে। একপর্যায়ে এসে লেজেগোবরে হয়ে যায়। সামাল দেওয়া যায় না।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলো জি-২০ (গ্রুপ অব টোয়েন্টি) সম্মেলন। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলোর ফোরাম এটি। সেখানে বাংলাদেশসহ সাতটি অসদস্য দেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকার ও পরিবারের কয়েক সদস্য নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। সব ছাপিয়ে উঠে এসেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মহার্ঘ্য সেলফি। এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
বিদেশের কোনো নেতা বা সংবাদমাধ্যম যদি বলে, বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল, শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৫০ ব্যক্তির একজন—আমরা আহ্লাদে আটখানা হই। আবার কেউ যদি বলে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিংবা নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, তখন আমাদের অনেকেরই গোস্সা হয়।
কার ওপর ভরসা করছে বিএনপি
আসল ব্যাপার হলো, তাদের কথা আমার পক্ষে গেলে তারা ভালো এবং তাদের কথা মধুর চেয়ে মিষ্টি। আবার তারা যদি সমালোচনা করে কিছু বলে, তখন আমরা বলি, বেটা হস্তক্ষেপ করছে। ইদানীং এসব কথা বেশ চালাচালি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিবৃতির জোয়ার দেখা যাচ্ছে—কখনো অভিনন্দন, কখনোবা হস্তক্ষেপের অভিযোগ। এখানে মূল বিষয় হলো, বিদেশিরা কী বলছে। আমাদের দেশের মানুষের মনোজগতে বিদেশিদের একটা সাফাই বা সার্টিফিকেটের অনেক দাম।
এর মধ্যেও কেউ কেউ মুখ ফসকে তেতো সত্য বলে ফেলেন। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২৫ বছর পূর্তিতে দুই দিনব্যাপী রজতজয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধনকালে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘আমরা সব বিষয়ে রোল মডেল খুঁজি। আমাদের রোল মডেল আমাদের ভূমিতে খুঁজতে হবে। আমরা স্বদেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর ধরি। আমাদের রোল মডেল, বিজ্ঞানী, নেতা—আমাদের দেশেই আছে। আগে দেশে খুঁজব, পরে বাইরে যাব।’
বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কথাবার্তায় আমাদের সরকারি মহলে উদ্বেগ ও উষ্মা এবং বিরোধী শিবিরে স্বস্তি ও আনন্দ দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে চলে গেছেন বিভক্ত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। আবার হাওয়ার গতি একটু এদিক-সেদিক হলেই তাঁদের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মার্কিন ভিসা নীতি বা স্যাংশন নিয়ে একটি মহলে উথালপাতাল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মুখেও হতাশার সুর শোনা গেছে, ‘২০ ঘণ্টা জার্নি করে নাহয় আটলান্টিক পাড়ি দেব না।’ কিন্তু সেদিন দিল্লিতে বাইডেনের সেলফি যেন ভোজবাজির মতো দৃশ্যপট পাল্টে দিল। এ নিয়ে রাজনীতির সুয়োরানি আর দুয়োরানির মধ্যে ক্যাচাল বেধে গেছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দমের খেলা
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপির মহাসচিবের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আজ নতুন একটা খবর আছে। দিল্লিতে কী হচ্ছে? জি-২০ (সম্মেলন)। এত দিন বিএনপি আটলান্টিকের ওপারে হোয়াইট হাউসের দিকে তাকিয়ে ছিল, বাইডেন সাহেব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসাবে—এই না? কী দেখলেন আজকে? বাইডেন সাহেব নিজেই সেলফি তুললেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তুলেছেন না? সঙ্গে আবার পুতুলও (সায়মা ওয়াজেদ) ছিল।… চোখে এখন অন্ধকার দেখছে, বিএনপির নেতারা বেলা থাকতে মিছিল শেষ করে হাত-পা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছেন। একজনেরও ঘুম আসবে না। রাতের ঘুম হারাম। কী শুনলাম, কী দেখলাম আর এখন কী হচ্ছে?’
বিএনপির মহাসচিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ওবায়দুল কাদের সাহেব নাকি বলেছেন, ফখরুল সাহেব এখন কী বলবেন। আমি বলি, আমার পরামর্শটা নেবেন। এই ছবিটা (জো বাইডেনের তোলা সেলফি) বাঁধিয়ে গলায় দিয়ে ঘুরে বেড়ান। ওটা আপনাদের যথেষ্ট সাহায্য করবে। এটা দিয়ে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাইডেন এখন আমার সঙ্গে আছে।’ (প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)
জো বাইডেন কি এখন তুরুপের তাস? তিনি কোন দিকে হেলবেন বা হেলেছেন, এ ভাবনায় দুই পক্ষের কারও ঘুম নেই বলে মনে হচ্ছে।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক