গরুর মন জটিল নয়। গবেষণা বলছে, গরুর মনের রয়েছে সরল রূপ, অবিশ্বাস্য রকমের সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তা—যা বোভাইন মেন্টালিটি হিসেবে পরিচিত। অনলাইনে প্রকাশিত ‘ইনসাইড দ্য মাইন্ড অব কাউজ’-এ উল্লেখ করা হয়েছে গরুর উচ্চ ধারণা, শিখন দক্ষতা ও গভীর আবেগ প্রসঙ্গ।
‘দ্য হিডেন লাইফ অব কাউজ’ নিবন্ধে প্রাণী আচরণবাদীদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, গরু জটিল সামাজিক প্রক্রিয়ায় মিথস্ক্রিয়া ও বন্ধুত্ব তৈরি করে এবং বন্ধুদের প্রতি অন্যেরা সহিংস হলে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
দুনিয়াজুড়ে গরুর মন পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। চমৎকার সব গবেষণা প্রতিবেদন ও গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। গৃহপালিত পশুদের মন, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সখ্য ও মানবসভ্যতায় ভূমিকা নিয়ে প্রকাশিত অ্যানিমেল কাইন্ড এ রকম একটি বেস্টসেলার বুক।
গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে গরুর সঙ্গে মানুষের রয়েছে প্রায় ১০ হাজার বছরের সখ্য। ভারতীয় উপমহাদেশে সেই হিসাব প্রায় সাত হাজার বছরের পুরোনো। গরুর রয়েছে স্পিরিচুয়াল, আর্থিক ও স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত মূল্য। গরুর সঙ্গপ্রিয়তার মূল্যও কম নয়।
গরুকে দেখার ক্ষেত্রে জনমনভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। গরুকে দেখা হচ্ছে অনেকটা যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। সংকরায়ণের মাধ্যমে তার আকারগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ দেশের গরুর যে চিরায়ত কাঠামো ও রং, তার স্বতন্ত্র ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
গরুর প্রতি মায়া প্রসঙ্গে আসা যাক, একবার রাজশাহী শহরসংলগ্ন সিটিতে কোরবানির গরু কেনার পর গরুর মালিক বলেছিলেন, ‘গরু বেচলাম, কিন্তু গরুর দড়ি তো বেচিনি।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেছিলেন, ‘দড়িটি রাখতে চাই স্মৃতি হিসেবে।’
গরুচাষিরা গরু পালেন দুটি পয়সার আশায়। কিন্তু এ পালন শেষ কথা নয়। গরু পালনের মধ্য দিয়ে চাষির সঙ্গে গরুর গড়ে ওঠে এক অমলিন সখ্য। গরুর প্রতি মায়া জন্মে যায়। বীজতলার সবুজ বীজ যেমন মায়ার আবেশ নিয়ে বেড়ে ওঠে, গরুও ঠিক তা-ই।
পাবলো নেরুদা আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘মানুষ একক জীবনযাপন করে না। একই সঙ্গে অন্যের জীবনও সে যাপন করে। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও প্রাণ-প্রকৃতি মানুষের যাপিত জীবনের অংশ। এ কারণে বসন্তকালে গাছ থেকে পাতা ঝরে গেলে মানুষ ব্যথা পায়। অথবা নদী শুকিয়ে গেলে আহত হয়। মানুষ কখনো আশ্রয় খুঁজে সমর্পিত প্রবীণ বৃক্ষের কাছে। লিখে ফেলে “একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা”।’
খামারে গরু চাষ আর গৃহে গরু পালনের ভেতরে পার্থক্য রয়েছে। খামারের বিষয়টি বাণিজ্যিক। খামারে গরুর বিজ্ঞাপন হয় পদ্ধতিগতভাবে। গরুর নম্বর ও নাম বসিয়ে। গরুর নামকরণে মধ্যে হলিনেস, বিশালত্ব ও হাস্যরস ক্যাটাগরি ব্যবহার করা হয়। নামকরণ মূলত ক্রেতাদের মন গলানোর জন্য। গরুর বাণিজ্যিকীকরণে গাভিদের কোনো স্থান নেই। আধিপত্যশীল শ্রেণি হলো ষাঁড়। মালয়ালমে একটি প্রবাদই রয়েছে—দুধ দেয় গাভিরা আর প্রচার পায় ষাঁড়েরা (মিল্ক বিলংস টু দ্য কাউ বাট বুল কাউ গেটস পাবলিসিটি)।
গ্রামের মানুষ যেভাবে জীবন যাপন করেন, গরুকেও সেই অভ্যস্ততায় গড়ে তোলেন। গৃহে আনার পর যত্নআত্তি করেন। মানুষ চাহিদামতো গরুর অভ্যাস গড়ে তোলেন। গরুকে হালচাষ, গাড়ি টানা, দুধ দেওয়াসহ নানা কর্মে প্রশিক্ষিত করে তোলেন। ইংরেজিতে একে টেমিং বা বশ মানানো। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে গরুর রয়েছে অসামান্য দক্ষতা। অল্পতেই সেই অভিযোজিত হয়, শিখে ফেলে। অজোয়াল থেকে জোয়ালওয়ালা গরুতে পরিণত হয়; অর্থাৎ দক্ষ হয়ে ওঠে।
গরুর ভূমিকা কৃষিকাজে ব্যবহার, স্বাস্থ্যসুবিধা নেওয়ার (দুধ ও মাংস) মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গরুর বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। গরু গৃহ থেকে খামার, গোয়ালঘর থেকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ, নিদেনপক্ষে ফ্যানের বাতাস, নিয়মিত চিকিৎসাসুবিধা, উন্নত খাবার পাচ্ছে।
খামারে গরু চাষ আর গৃহে গরু পালনের ভেতরে পার্থক্য রয়েছে। খামারের বিষয়টি বাণিজ্যিক। খামারে গরুর বিজ্ঞাপন হয় পদ্ধতিগতভাবে। গরুর নম্বর ও নাম বসিয়ে। গরুর নামকরণে মধ্যে হলিনেস, বিশালত্ব ও হাস্যরস ক্যাটাগরি ব্যবহার করা হয়। নামকরণ মূলত ক্রেতাদের মন গলানোর জন্য। গরুর বাণিজ্যিকীকরণে গাভিদের কোনো স্থান নেই। আধিপত্যশীল শ্রেণি হলো ষাঁড়। মালয়ালমে একটি প্রবাদই রয়েছে—দুধ দেয় গাভিরা আর প্রচার পায় ষাঁড়েরা (মিল্ক বিলংস টু দ্য কাউ বাট বুল কাউ গেটস পাবলিসিটি)।
প্রান্তিক গরুচাষিদের গরুর বিপণনে নেই কোনো বিশেষ উদ্যোগ। নিছক একটি বা দুটি গরু পালেন সন্তানস্নেহে। দুটি পয়সা আয়ের আশায়। এ অনুশীলনে আবেগ ও অর্থনীতি দুটি মিশে আছে। খামারভিত্তিক গরু চাষে আবেগ বা অনুরাগের স্থান নেই।
মানুষ বুঝেছে, তুলনামূলক অন্য প্রাণীদের তুলনায় গরু বশীকরণ সহজ। এ কাজে মানুষের রয়েছে আকাশচুম্বী উৎকর্ষ। অন্যদের সক্ষমতা ভুলিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদের সক্ষমতা নিজের স্বার্থের উপযোগী করে তোলাই বশীকরণ প্রক্রিয়ার মূল তৎপরতা।
বশীকরণের অংশ হিসেবে ষাঁড়ের প্রজননক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বলদে পরিণত করা হয়েছে। ভাষাবিদ কলিম খান তাঁর এক প্রবন্ধে মানবজীবনকে ‘বরাহকরণ প্রকল্প’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যেখানে নির্ভেজাল আনুগত্য উৎপাদন করা হয়, বলদ তৈরি করা হয়। তিনি উদাহরণ দেন, শিক্ষাদীক্ষা শেষে অন্যের অধীনে চাকরি পেয়ে মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেন। বশীকরণের আওতায় আসে। বশীকরণ প্রকল্পের আওতায় যাওয়া ব্যক্তির একধরনের সুপ্ত বাসনা।
গরুর বশীকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো স্বাধীনতা থাকে না। গরু হয়ে উঠে নির্দেশ প্রতিপালনে এক নিরীহ প্রাণী। মানুষ তাকে নিরীহ বলে। কারণ, সেই বাধ্য ও অনুগত, বিক্ষুব্ধ বা অবাধ্য নয়। গরু বাঙালি সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গরুর সঙ্গে মালিক ও পরিবারের সদস্যদের রয়েছে এক দারুণ মিথোজীবিক সম্পর্ক। বছরখানেক আগে মুক্তি পাওয়া সাঁতাও সিনেমাতে তা তুলে ধরা হয়েছে ভিন্ন উচ্চতায়।
শিল্প-সাহিত্য, গল্প-কবিতায় গরুর নির্মাণ হয়েছে ইতি এবং নেতির মাত্রায়। গরু শ্লেষের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আহমদ ছফা তাঁর বিখ্যাত গাভি বৃত্তান্ত উপন্যাসে চিত্রায়ণ করেছেন একজন উপাচার্যের গোলামি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির নোংরা কদর্য রূপ।
গরুর সম্মানসূচক প্রতিস্থাপন রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো অক্সফোর্ড, যার আদ্যন্তে রয়েছে ষাঁড়। আরেকটি হলো গবেষণা। যার আগে রয়েছে ‘গো’। যার সন্ধিবিচ্ছেদ হলো গো +এষণা। যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা মূলত গরু খোঁজেন।
কারও কি গরু হওয়ার সাধ জাগে? মাহা মির্জা ২৬ মে, ২০১৯ প্রথম আলোয় কৃষি: কৃষকের ধান ও ‘রোল মডেল’ রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা বিষয়ে একটি কলাম লেখেন। সেখানে ভারতীয় কৃষকের এক স্বপ্ন উঠে এসেছে, ‘ইউরোপের প্রতিটি গরু বছরে প্রায় ৭০ হাজার টাকা ভর্তুকি পায় (দিনে প্রায় আড়াই ডলার); অর্থাৎ ইউরোপীয় গরুগুলোর দৈনিক আয় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের দৈনিক আয়ের চেয়ে বেশি। ঠাট্টা করে বলা হয়, ইউরোপের দুই কোটি গরু যে পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পায়, তা দিয়ে প্রতিটি গরু ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে লম্বা অবকাশ যাপন করে ফিরতে পারবে।’
সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার এক ভারতীয় কৃষক সংগঠককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন কী?’ উত্তর এসেছিল, ‘পরের জন্মে ইংল্যান্ডের গরু হয়ে জন্ম নেওয়া।’
আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। গ্রামের বাড়িতে গরু ছিল। গরুর সঙ্গে সখ্য ছিল। শৈশবে আদর করে একটি বাছুরের নাম রেখেছিলাম লিদু। লিদু সব সময় পেছন পেছন ঘুরত। গা ঘেঁষে থাকত। বিছানার পাশে শুয়ে থাকত। লিদুর আবেগ-অনুরাগ জানতে ইচ্ছা করত। বুঝতে পারিনি। তবে বুঝতে পারতাম, তার নিখাদ ভালোবাস। গরুবিষয়ক যেকোনো আলোচনায় লিদুর চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
গরুদের পারস্পরিক কথাবার্তা নাকি বোঝা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার গবেষকেরা তা আবিষ্কার করেছেন। কাউজ ক্যান টক ইচ আদার হাউ দ্য ফিল স্টাডি ফাইন্ডিং শিরোনামে ব্রিটেনের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আমার আগ্রহ মানুষ সম্পর্কে গরুদের মূল্যায়ন কী, তা জানা। কারণ, মানুষ বোকা অর্থে গরু শব্দটি যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে।
খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক