২০১১ সাল থেকে ২৭টি ডিজিটাল পরিষেবা খাতে কর অব্যাহতি দিয়েছিল সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সে কর অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হলে তা আবার চার বছরের জন্য বাড়ানো হয়। নতুন কোনো ঘোষণা না এলে চলমান এই কর অব্যাহতির মেয়াদ এ অর্থবছরে শেষ হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো ইতিমধ্যে এই অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে। অতীতেও বাজেট ঘোষণার আগে সংগঠনগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের আবেদন জানানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়েছিল বলে মনে হয় না। অবশ্য সেসব আবেদন যতটুকু না আবেদন, তার চেয়ে বেশি ‘আবদার’ বলে প্রতীয়মান হয়। তথ্য-উপাত্তনির্ভর যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য সেখানে বেশি।
সরকার কেন কর অব্যাহতি দেবে? সরকারকে তো হিসাবটা করে দেখাতে হবে যে কর অব্যাহতি না দিলে সম্ভাব্য কত টাকা রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে, আর অব্যাহতি দিলে কত টাকা লাভ হবে। এ খাতে লাভ-ক্ষতি, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি ডেটা সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর কাছেই সবচেয়ে বেশি থাকার কথা। প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের মেলা আয়োজনের পাশাপাশি সংগঠনগুলো যদি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সমীক্ষাগুলো (স্টাডি) করিয়ে ফেলত, তাহলে সরকারের কাছে দাবিদাওয়াগুলো আরও কার্যকরভাবে পেশ করা যেত।
গত ১২-১৩ বছর কর অব্যাহতি দেওয়ার পর এখনো কেন কর অব্যাহতির দাবি করা হচ্ছে, সেটি একটু স্পষ্ট করা দরকার। সরকার এক যুগ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন নিয়ে এগিয়েছে, সেটির মূল প্রযুক্তিই ছিল তথ্যপ্রযুক্তি। এক যুগ পর সরকার তো থেমে যায়নি, নতুন করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি থেমে না যায়, কর অব্যাহতি কেন থেমে যাবে?
তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সেটির উৎস সম্পর্কে অবহিত করাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বিভিন্ন দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে বলা হয়, সরকারি (অফিশিয়াল) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশি সফটওয়্যার এবং প্রযুক্তি পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের একটি স্থানীয় বাজার গড়ে তুলেছে, রপ্তানি ছাড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এটা কোন সরকারি হিসাব? কোন প্রতিবেদনে, কোন পদ্ধতিতে এই হিসাবে এসেছে? এসব তথ্য দেওয়ার সময় স্পষ্টভাবে সেগুলোর গ্রহণযোগ্য উৎস উল্লেখ করতে হবে। তাহলে তথ্যের উপস্থাপনা আরও বলিষ্ঠ হবে।
গত ১২-১৩ বছর কর অব্যাহতি দেওয়ার পর এখনো কেন কর অব্যাহতির দাবি করা হচ্ছে, সেটি একটু স্পষ্ট করা দরকার। সরকার এক যুগ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন নিয়ে এগিয়েছে, সেটির মূল প্রযুক্তিই ছিল তথ্যপ্রযুক্তি। এক যুগ পর সরকার তো থেমে যায়নি, নতুন করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি থেমে না যায়, কর অব্যাহতি কেন থেমে যাবে?
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই কর অব্যাহতির সঙ্গে ডিজিটালাইজেশন এবং স্মার্টাইজেশনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। এর বাস্তবায়ন তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা, সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সরঞ্জামাদির সহজলভ্যতার ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, শুধু নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের ওপর বিক্রয় কর বাদ দেওয়ার প্রভাবে প্রথম বছর শেষে ৩ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার এবং দুই বছরে ৯ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে (কাটজ্ ও ক্যালোর্ডা, ২০১৯)।
আমরা কেবল তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পেতে শুরু করেছি। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আইসিটি ল্যাব যুক্ত হচ্ছে, পাঠ্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে প্রোগ্রামিং। ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হতে শুরু করেছেন লাখো তরুণ। বাড়তে শুরু করেছে ই-কমার্স লেনদেন। বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, কার্ডে লেনদেন বাড়ার খবর, ক্যাশলেস সোসাইটি করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করতে শুরু করেছে ইলেকট্রনিক ও আইসিটি পণ্য। এসব অর্জনের পেছনে সন্দেহাতীতভাবে সরকারের নেওয়া কর অব্যাহতির ভূমিকা আছে। সে ভূমিকাটুকু পরিমাপ করে তথ্যটুকু উপস্থাপন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এটুকু বোঝার জন্য সমীক্ষার প্রয়োজন হয় না যে এখনই এই কর অব্যাহতি উঠিয়ে নিলে মুখ থুবড়ে পড়বে গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
এইচএসবিসি বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হতে যাচ্ছে, যেটি ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাজ্যকেও। এ বাজারের বড় একটি অংশ দখলে থাকবে ডিজিটাল পণ্যের। উপযুক্ত নীতির অভাবে অন্যের দখলে যেতে পারে আমাদের এ বৃহৎ বাজার।
২০২২ সাল পর্যন্ত এশিয়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অর্থাৎ ইউনিকর্নের সংখ্যা ছিল ৩২৭টি, সেখানে ২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যই নির্ধারিত আছে মাত্র ৫টি। ২০২২ সালে ভারতীয় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো সংগ্রহ করেছে ২১ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আমরা করেছি মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে ভারত ও চীনের স্টার্টআপে মাথাপিছু বিনিয়োগ প্রায় ১৫ ডলার ও ৩৩ ডলার, যেখানে আমাদের বিনিয়োগ ১ ডলারের কম (বাংলাদেশ স্টার্টআপ বিনিয়োগ রিপোর্ট, ২০২৩)।
এ অবস্থায় যদি প্রথমে একটু কর আরোপ করে ধীরে ধীরে বাড়ানোর পরিকল্পনাও যদি করা হয়, সেটিও ভালো বার্তা দেবে না। বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাব ফেলবে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে। বরং পর্যালোচনা বা পুনর্বিচার করা যেতে পারে এক যুগের বেশি সময় ধরে যে ২৭টি পরিষেবাকে করের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে, সেখানে কোনো সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন আছে কি না।
বিশেষ করে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে যেসব উদীয়মান প্রযুক্তি লাগবে, সেগুলোকে কীভাবে আরও সহজলভ্য করা যেতে পারে, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে যে মানবসম্পদ তৈরির সূচকে আমরা পিছিয়ে ছিলাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর অব্যাহতি দিয়ে সেটিকে কী করে আরও বেগবান করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়াটাই এখন বেশি জরুরি।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক