ইমরান খানের এই রাজনৈতিক উত্থানের নেপথ্যে

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানফাইল ছবি: রয়টার্স

অস্বীকার করার উপায় নেই, ইমরান খানের সমর্থনে একটি শক্তিশালী জনপ্রিয়তার ঢেউ উঠেছে। এই সত্যকে অস্বীকার করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। কোনো বিচক্ষণতা নেই। ইমরান খান ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাজনীতির সূর্যও অস্ত যাবে—এই ভবিষ্যদ্বাণী এখন ভুল প্রমাণিত হচ্ছে।

যখনই দেখা গেছে ইমরানের পথে খারাপ কিছু এসে হাজির হয়েছে, ঠিক তখনই তিনি এমন কিছু করেছেন এবং তার ফলে এমন কিছু এসে হাজির হয়েছে যা তাঁর প্রাণশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে। ইমরানের করা সেই ‘এমন কিছু’ বরাবর একই থাকে। সেটি হলো: জনগণের কাছে আবেদন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের পর তার পরের মাসেই তিনি ইসলামাবাদ অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেন। অবশ্য সেই লংমার্চ বিশেষ কিছু ঘটিয়ে ফেলার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক লোক জড়ো করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি ইসলামাবাদে পৌঁছার পর হঠাৎ লংমার্চ বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং বানিগালায় নিজের বাড়িতে অবস্থান করা শুরু করেছিলেন।

অনেকের ধারণা ছিল, ২০১৪ সালে ইমরানের ডাকে তথাকথিত সুনামি বিক্ষোভ হওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এবার আর সে ধরনের জনসমর্থন তিনি পাবেন না। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছিল, সে সময় তাঁর আন্দোলনে পর্দার আড়ালের শক্তির সমর্থন ছিল। এবার আর তিনি সে ধরনের সমর্থন পাননি। কিন্তু ইমরান আবার সেই জনগণের দিকেই সাহায্যের আবেদন নিয়ে গেছেন এবং মিছিল শোভাযাত্রার ডাক দিয়েছেন। এসব সমাবেশের অনেকগুলোই সফল হয়েছে। সমাবেশে তিনি জ্বালাময়ী জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা দিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

২০২২ সালে পিটিআই যে ২০টি আসন থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আসনগুলোতে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ১৫টি আসনেই ইমরান জিতেছিলেন। ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের অনেক নিচে যে বড় আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে, এই ঝাঁকুনিটিই ছিল তার প্রথম লক্ষণ। কেউ কেউ ইমরানের এই জয়কে সে সময় খাটো করে দেখাতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, এই আসনগুলো যেহেতু ইমরানের দলেরই ছেড়ে দেওয়া আসন, সে কারণে এই জয় এসেছে।

আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, শাহবাজ শরিফের পিডিএম সরকার মূল্য সমন্বয় করতে গিয়ে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর যে মূল্যস্ফীতি হয়, তা জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছিল। আর এতেই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে একধরনের জনমত তৈরি হয়েছিল। এ কারণে ইমরান এতগুলো আসন পেয়েছিলেন।

তবে এরপর ২০২২ সালের অক্টোবরে আরেক দফা উপনির্বাচন হয়। মোট ১১টি আসনে উপনির্বাচন হয়। এতে ইমরান নিজে সাতটি আসনে প্রার্থী হন এবং ছয়টিতেই জিতে যান। এর মধ্য দিয়ে তখন প্রতীয়মান হয়েছে, ইমরান খান যখনই জনগণের কাছে গেছেন, তখনই তিনি তাঁর শক্তিকে নবায়ন করে ফিরেছেন।

৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছিল ইমরানের জনগণের কাছে যাওয়ার পরবর্তী মোক্ষম সময়। কিন্তু এই দফায় তিনি জনগণের কাছে যেতে পারেননি। এবার জনগণের প্রতি তাঁর আবেদনকে দমন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এই দফায় তিনি জেলে ছিলেন। তাঁর দলের কোনো প্রতীক ছিল না। তাঁর কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে বা অন্য কোনো দলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। সর্বোপরি তাঁর প্রার্থীরা নির্বাচনী সভা সমাবেশ করতে পারেননি।

নির্বাচন কমিশন যে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করেছে, তার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে কারসাজি করার বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ এসেছে। এরপরও ইমরানের প্রার্থীরা মোট পড়া ভোটের এক-তৃতীয়াংশ পেয়েছেন। ইমরান খান যে ভোটারদের সঙ্গে একটি শক্তিশালী যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেছেন, সেটিকে অস্বীকার করা বা সেটিকে ছোট করার চেষ্টা করার এখন কোনো মানে হয় না। এখন এটি পরিষ্কার, ক্ষমতাসীন শক্তি যত বেশি তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে, জনগণের সঙ্গে তাঁর এই সংযোগ তত দৃঢ় হবে; তিনি আরও বেশি মানুষের সহমর্মিতা জয় করতে থাকবেন।

ইমরানের সঙ্গে জনগণের এই যোগসূত্রের পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কোনো বিষয়টি কাজ করেছে, তা নিয়ে এখন সব ধরনের তত্ত্ব ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, এগুলো আসলে ‘অ্যান্টি-এস্টাবলিশমেন্ট’ ভোট। আবার কেউ কেউ বলেন, টানা ২০ মাসের বেশি সময় ধরে রেকর্ড উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি চলেছে। এটি মানুষকে ইমরানের দিকে চালিত করছে। কেউ বলছেন, এটি আসলে খানের প্রতি ভোটারদের ভালোবাসা নয়, এটি নওয়াজ শরিফের প্রতি তাঁদের অপছন্দ (কিংবা ঘৃণাও বলা যায়)।

 আমরা এসব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে পারি, কিন্তু জনগণের কাছে ইমরানের যে একটি প্রচণ্ড জোরালো আবেদন তৈরি হয়েছে, তা এড়িয়ে যেতে পারি না। খান যে সফলতা পেয়েছেন, তা বোধ করি তিনি নিজেও কল্পনা করেননি। মনে রাখা দরকার, পাকিস্তানে এখন যত ভোটার আছে, তাদের একটি বিরাট অংশ তরুণ। তাদের দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন।

পর্দার আড়ালে থাকা ক্ষমতাধর গোষ্ঠী গতানুগতিক রাজনীতিকে আগের দিনে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যত সহজে সফলতা পেত, এখন আর সেটি সম্ভব নয়। কারণ, এই তরুণেরা সম্পূর্ণ নতুন ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। তাদের সঙ্গে যারা মানিয়ে চলতে পারবে, তারাই দিন শেষে রাজনীতিতে টিকবে। যারা পারবে না, তাদের সরে যেতে হবে।

  • খুররম হুসাইন পাকিস্তানের সাংবাদিক ও লেখক

  • ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত