কমলা হ্যারিস তাঁর নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় হিসেবে নাগরিক স্বাধীনতাকে বারবার সামনে আনছেন। তাঁর ওয়েবসাইটে ‘আমাদের মৌলিক স্বাধীনতাগুলোকে সুরক্ষিত করুন’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারিস আমাদের ভবিষ্যতের জন্য যে সংগ্রাম করছেন, সেটি আমাদের স্বাধীনতারও লড়াই।
এই নির্বাচনে অনেক মৌলিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে রয়েছে। সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই আপনার নিজের শরীর সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা হুমকিতে আছে; যার প্রতি আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করতে চান, তাকে গর্বের সঙ্গে ভালোবাসতে পারার স্বাধীনতা হুমকিতে আছে; এবং যে স্বাধীনতা অন্য সব স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে, সেই ভোট দেওয়ার স্বাধীনতাও হুমকিতে আছে।’
এটি স্বাগত জানানোর মতো একটি বার্তা। আমেরিকান প্রগতিশীলরা মনে করছেন, স্বাধীনতার এজেন্ডাকে অতি উদারবাদী ও ডানপন্থীদের খপ্পর থেকে পুনরুদ্ধার করার এখনই সময়। বিশেষ করে যখন ডানপন্থীরা আমেরিকান মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর প্রতিনিধিত্ব করছেন, সে মুহূর্তে স্বাধীনতার এজেন্ডা পুনরুদ্ধারই নজর দেওয়ার প্রধান বিষয় বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। ডানপন্থীরা নিজেদের অতিরক্ষণশীল ধ্যানধারণাকে জাতীয় পতাকায় আড়াল করার চেষ্টা করলেও প্রগতিশীলরা আমেরিকার প্রকৃত স্বাধীনতার এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসছেন। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এসব বিষয় স্পষ্ট হবে।
প্রথমত, নাগরিক স্বাধীনতার একটি মৌলিক অংশ হলো নিজের পছন্দ ও সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনযাপন করার স্বাধীনতা। যারা দিন এনে দিন খায় কিংবা অনাহারের মুখোমুখি হয়, বাস্তবে আসলে তাদের কোনো স্বাধীনতা নেই; তারা মূলত টিকে থাকার জন্য যা করতে হয়, তা-ই করে।
দ্বিতীয়ত, যেকোনো সমাজে পারস্পরিক নির্ভরশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু মানুষের স্বাধীনতা অন্যদের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে। অক্সফোর্ডের দার্শনিক আইজাইয়া বার্লিনের মতে, ‘নেকড়েদের স্বাধীনতা অনেক সময় ভেড়ার জন্য মৃত্যু নিয়ে আসে।’ সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করত, তাহলে ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের আর্থিক উদারীকরণ, তথা ব্যাংকারদের স্বাধীনতা আমেরিকান অর্থনীতির মৃত্যু ঘটিয়ে দিতে পারত। তবে সেই সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে করদাতাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছিল। এতে করদাতা এবং অনেক শ্রমিক ও বাড়ির মালিকদের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে।
তৃতীয়ত, কিছুটা বাধ্যবাধকতা সবার জন্য স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে পারে। যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করি, তখন আমরা এমন কিছু করতে পারি, যা একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে কেউ যাতে কোনো রকম পয়সা খরচ না করেই সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নিতে না পারে, সে জন্য কিছু বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা চালুর প্রয়োজন হতে পারে।
চতুর্থত, নব্য উদার অর্থনীতি আজকের দিনে করপোরেশনগুলোকে অন্যদের শোষণ করার স্বাধীনতা দিয়েছে। এটি সামগ্রিক সমৃদ্ধি আনতে পারেনি। সবাই ভোগ করতে পারে, এমন সমৃদ্ধি এই অর্থনীতি আনতে পারেনি।
রোনাল্ড রিগ্যান ও মার্গারেট থ্যাচারের সময়ে নিওলিবারেলিজম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি অনেক আগেই অর্থনীতিবিদেরা অনুমান করেছিলেন। এর চেয়ে বড় কথা, নব্য উদারবাদ বা নিওলিবারেলিজম টেকসই নয়। এর কারণ, এটি ব্যক্তিগত স্বার্থকে উৎসাহিত করে এবং বাজারের এমন আচরণকে প্রভাবিত করে, যা অর্থনীতির কার্যকারিতাকে ব্যাহত করে।
অর্থনীতি বিশ্বাসের ওপর চলে। চলতি বছর অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া ড্যারন আসেমোগলু, সিন জনসন ও জেমস এ রবিনসন প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, যখন লোভী ব্যক্তিরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আদর্শ ভঙ্গ করে এবং অতিমাত্রায় অসততা প্রদর্শন করে, তখন ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোও কাজ করে না।
পঞ্চমত, মিল্টন ফ্রিডম্যান ও ফ্রিডরিখ হায়েকের মতো অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অবাধ বাজার রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় নয়; এমনকি তা সহায়কও নয়। যেসব দেশে সরকার দারিদ্র্য, অসমতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি মোকাবিলায় যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়নি, সে দেশগুলোতেই কর্তৃত্ববাদী জনতুষ্টিবাদের উত্থান সবচেয়ে বেশি হয়েছে।
কমলা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে মূল স্বাধীনতার বিষয়ে (যেমন একজন নারীর নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণের অধিকার) তীব্র বৈপরীত্য রয়েছে। এই নির্বাচনের প্রতিটি বড় ইস্যুতে হ্যারিস আমেরিকানদের স্বাধীনতা প্রসারিত করবেন, আর ট্রাম্প তা সংকুচিত করবেন। হ্যারিসের এজেন্ডার কেন্দ্রে আছে সাধারণ আমেরিকানদের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তাঁর প্রতিশ্রুতিতে ট্রাম্পের শাসনামলের পরীক্ষিত ব্যর্থ ‘ট্রিকল-ডাউন’ অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়ার বিষয় নেই।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ধনী এবং বৃহৎ করপোরেশনগুলোর জন্য কর হ্রাস কয়েক বছরের মধ্যে দেশের ঋণে আনুমানিক ৭ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন যোগ করবে এবং এই বোঝা আমেরিকানদের সন্তানসন্ততি ও নাতি-নাতনিদের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করবে। মহামারি এবং তার পরের সময়ে বিশ্বব্যাপী যে মুদ্রাস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছিল, তা যদিও এখন নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তবে আমেরিকানরা ওষুধ এবং আবাসনের মূল্য নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন রয়ে গেছেন।
কমলা হ্যারিস মূল্যবৃদ্ধি রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে তাঁর প্রস্তাবকে (ইচ্ছাকৃতভাবে) ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি ফেডারেল সরকারের দাম নির্ধারণ করার পক্ষে নন এবং অনেক অঙ্গরাজ্যে ইতিমধ্যেই মূল্যবৃদ্ধি-বিরোধী আইন রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানগুলোকে হারিকেন ও বন্যার মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে শোষণ করার সুযোগ থেকে বিরত রাখে। তবে মহামারি দেখিয়েছে, এ ধরনের নীতি আরও জোরদার ও কার্যকর হওয়া প্রয়োজন।
ট্রাম্প চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর শুল্ক ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি করা হলে চীন থেকে আমদানি করা পোশাক, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য অনেক সাধারণ পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। যেহেতু সাধারণ মার্কিন নাগরিকেরা এসব পণ্য কেনেন, সেহেতু এই বর্ধিত দামের চাপ তাঁদের ওপর পড়বে। প্রকৃতপক্ষে ট্রাম্প যে অর্থনৈতিক এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের আমেরিকানদের ওপর একটি বিশাল প্রতিক্রিয়াশীল করের মতো চেপে বসবে। ভোক্তা হিসেবে তাঁদের স্বাধীনতা হ্রাস পাবে, কেননা তাঁরা ইচ্ছেমতো ব্যয় করতে যে অর্থ দরকার, তাঁরা তা পাবেন না।
হ্যারিস যে পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন, তা আবাসনের (বাড়ি ও ফ্ল্যাট) সরবরাহ বাড়াতে এবং তার খরচ কমাতে সাহায্য করবে। এটি প্রথমবারের মতো যাঁরা বাড়ি কিনছেন, তাঁদের সামর্থ্য বাড়াবে। ট্রাম্প এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব রয়েছেন। সর্বশেষ কথা হলো, হ্যারিসের এজেন্ডায় সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনযাপনের স্বাধীনতা দেওয়ার বাস্তব পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
● জোসেফ ই স্টিগলিৎস অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী লেখক, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টাদের কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ