এখনকার শিক্ষার্থীদের কোনো প্রশ্ন নেই, সারারাত জাগে, কেমন যেন মনমরা

আমি একজন শিক্ষক। প্রকৌশল শিক্ষক। সেই ১৯৮৬ সালে এ পেশায় আসা। দেখতে দেখতে ৩৮ বছর পার হতে চলেছে। রাজশাহীর তদানীন্তন বিআইটিতে (পরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) যোগদান করলাম। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল (ইইই) বিভাগে।

তারুণ্যের উদ্দীপনায় টগবগে তরুণ শিক্ষক। ব্যাচেলর ডিগ্রি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। কিন্তু বাড়ি আমার রংপুরে। তাই স্বাভাবিক কারণে উত্তরাঞ্চলের প্রতি অনেক দুর্বলতা। আমরা ‘মফিজ’ হিসেবে পরিচিত। আয়োডিনের অভাবে আমরা নাকি বুদ্ধিমত্তায় অনেক পিছিয়ে। তাই মফিজ হয়েই শুরু করলাম কর্মজীবন।

যোগদানের পর প্রতিষ্ঠান হলো আমার জানের জান। ছাত্রছাত্রীরা হলো আমার বিশেষ অনুরক্ত। সপ্তাহে কর্মসময় নির্ধারণ করে দেওয়া হলো ২৫ ঘণ্টা। তাতে কি? সব সময় ছাত্রছাত্রীদের সংস্পর্শে থাকা অদ্ভুত আনন্দের মধ্যে সময় পার হতো।

ল্যাবে যখন যেতাম, প্রতিটি গ্রুপের কানেকশন নিজ হাতে চেক করতাম। ছাত্রছাত্রীদের তত্ত্বলব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিকভাবে প্রয়োগের সংযোগ করে দিতাম। কত প্রশ্ন তাদের। সব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকত না। বলতাম সন্ধ্যায় অফিসে এসো।

ক্যাম্পাসে অবিবাহিত শিক্ষকদের থাকার কোনো রকম একটা ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং ছাত্রছাত্রীদের অনেক সময় দিতে পারতাম তখন।

৩৮ বছর আগের কথা। ছাত্রছাত্রীদের জানার আগ্রহ ছিল অফুরন্ত। এসব লিখছি এ কারণে যে কয়েক যুগ আগের সেই সমাজ এখন আর নেই। আমার ছাত্রছাত্রীদের সবাই এখন দেশ-বিদেশে প্রকৌশল পেশায় নিয়োজিত। তাদের অনেকের ছেলেমেয়ে এখন আমার ছাত্রছাত্রী। এখন আমি ‘দাদা শিক্ষক’। ২০০৭ সালে গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) চলে এসেছি।

আমার এখনকার ছাত্রছাত্রীরা নতুন প্রজন্মের। তাদের হাতে থাকে স্মার্টফোন। আর আছে ইন্টারনেট সংযোগ। প্রকৌশলবিদ্যার সব তত্ত্ব–তথ্য–উপাত্ত সবই এখন অত্যন্ত সহজলভ্য। বিজ্ঞান–প্রযুক্তি–গবেষণা এখন এত দূর এগিয়েছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যা খুশি করা সম্ভব।

মনে পড়ে, ১৯৯৪ সালে কানাডায় যখন পিএইচডি করি, তখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে আমি মোটরের গতি নিয়ন্ত্রণের গবেষণা করি। এসব তো পুরোনো কথা। যা লিখতে চাইছি তা হলো বর্তমান আর আগের প্রজন্ম নিয়ে।

যেহেতু আমার পদচারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ, তাই এ জগতের বাসিন্দাদের কথাই বলি। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের জানার আগ্রহ অনেক কম। ক্লাসে পড়াই। আশা করি ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে। কিন্তু এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা তেমন কিছু জিজ্ঞেস করে না। এই প্রজন্ম সারা রাত জাগে। নিশ্চয় অনেক লেখাপড়া করে। কিন্তু ক্লাসে এসে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে। ক্লাস করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই কেমন যেন মনমরা। তারুণ্যের হাসিখুশি লাফালাফি এদের মধ্যে অনেক কম।

কী হলো এদের? কিসের এত চাপ বা বিষণ্নতা? দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে মাদকের ছড়াছড়ি। যুব সমাজ কিসের নেশায় বুঁদ, জানি না। আশপাশের ন্যায়–অন্যায়ে এদের তেমন কিছু যায় আসে না। যেকোনো অন্যায় বা অবৈধভাবে আয় করা যে মূল্যবোধ ও সুশিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা বোঝার শক্তি এদের নেই বললেই চলে। বরং ওসব দেখে এদের অনেকেই অতি দ্রুত অগাধ অর্থসম্পদ অর্জনের স্বপ্ন দেখে। বৈধ–অবৈধতার সীমারেখা এ সমাজে আর নেই। কারও বিয়ে দিতে এখন সৎ পাত্র–পাত্রীর সন্ধান করে না। কার কত ক্ষমতা, কত টাকাপয়সা—সেটাই মুখ্য বিষয়।

গণতন্ত্র বলে সারা দুনিয়ায় কিছু আছে নাকি? সারা দুনিয়ায় তো পেশিশক্তির জয়জয়কার। মুখে মানবতা আর মারণাস্ত্র সরবরাহ করে নারী–শিশুসহ মানুষ নিধনে মোড়লদের প্রতিযোগিতা। এরই মধ্যে দেশের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো ছাত্রছাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায়। তাই তো আশা জাগে, তারুণ্য এখনো মরে যায়নি। নিশ্চয় ভালো কিছু আশা করতে পারি।

  • ড. মো. আশরাফুল হক আইইউটির ইইই বিভাগের অধ্যাপক