যে কারণে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ এখনো রাশিয়াপন্থী

বুলগেরিয়ার সোফিয়াতে মস্কোর সমর্থনে রাশিয়ান পতাকা হাতে রাস্তায় নেমেছে মানুষ।
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে গত বছর রাশিয়া বড় ধরনের আক্রমণ চালানোর পর ইউরোপ রাতারাতি বদলে গেছে। এটি ইউরোপের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গঠনাত্মক আদলে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে, যা জ্বালানি বাজারকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং বিদ্যমান সরবরাহ শৃঙ্খলকে খণ্ড–বিখণ্ড করে ফেলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় মূল অ্যাজেন্ডা ছিল শান্তি। সেই শান্তিকেই এই যুদ্ধ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপকে অস্থির করেছে। অঞ্চলটিতে রুশ দখলদারির স্মৃতি এখনো টাটকা আছে। এ কারণেই রাশিয়ার ওপর অবরোধ আরোপের কারণে এ অঞ্চলের দেশগুলো ইউক্রেনকে আর্থিক, সামরিক সহায়তা দিচ্ছে এবং ইউক্রেন থেকে এখানে আসা লাখ লাখ শরণার্থীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

তবে অতীতে এ অঞ্চলে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়ে শান্তি বিঘ্নিত করলেও এখনো এখানকার কয়েকটি দেশ রাশিয়ার প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে চলেছে। স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি গত বছরজুড়ে কথা ও কাজের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রতি তাদের সহমর্মিতা প্রদর্শন করে আসছে।

আরও পড়ুন
ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার আরটি, স্পুতনিকসহ রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করলেও মস্কো সত্য-মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, তা ইইউ ঠেকাতে পারছে না

গত সেপ্টেম্বরে স্লোভাকিয়ায় চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে, সেখানকার বেশির ভাগ মানুষ বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক জয়কে তারা স্বাগত জানাবে। আর গত বছরের মে মাসে চালানো ভিন্ন একটি জরিপে দেখা গেছে, বুলগেরিয়ার মাত্র ৩৩ শতাংশ এবং হাঙ্গেরির ৪৫ শতাংশ নাগরিক রাশিয়াকে হুমকি মনে করে। ২০২২ সালের শেষভাগে ইউরোব্যারোমিটার সার্ভে নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চালানো জরিপে দেখা গেছে, রাশিয়ার ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞায় হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া সমর্থন দিলেও তা ছিল দুর্বলতম।

সে দুর্বলতা তাদের সরকারি নীতি ও কথাবার্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। ন্যাটো এবং ইইউ সদস্যদের মধ্যে বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং ইউক্রেনকে অস্ত্র দিলে তা এই দেশগুলোকে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে ফেলবে বলে যে জনপ্রিয় ধারণা চালু আছে, তার প্রতি দেশ দুটির সায় প্রতিফলিত হয়েছে। বুলগেরিয়ার সাবেক সরকার কিয়েভকে বিস্ফোরক ও জ্বালানি দিলেও সেটি তারা দিয়েছিল জনগণকে না জানিয়ে।

স্লোভাক সরকার ভারী সমরাস্ত্র সরবরাহসহ ইউক্রেনকে সহায়তা হিসেবে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সহায়তাদানকারীদের মতো নিজের জিডিপির একটি অংশ দিলেও গত বছর ইইউর ওপর রাশিয়ার তেল নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে রাশিয়া ইস্যুতে হাঙ্গেরির পাশাপাশি নিয়ে আসে। কেবল রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধ করলেই রাশিয়া ইউরোপকে গ্যাস দেবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর ব্রাতিস্লাভা ও বুদাপেস্ট উভয়েই বলেছে, তাদের পিঠ যদি দেয়ালে ঠেকে যায়, তাহলে তারা রুবলেই রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস কিনবে। ব্রাসেলসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যতবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আলোচনা হয়েছে, ততবারই হাঙ্গেরির প্রশাসন তাতে বাধা দিয়েছে এবং তার নিজ ভূখণ্ডে রুশবিরোধী প্রোপাগান্ডায় তারা বাধা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

এই দুই দেশে রুশপন্থী মনোভঙ্গি ক্রমাগতভাবে বাড়ার সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস ও রাশিয়া থেকে সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পূর্ব ইউরোপ স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির যে আশা নিয়ে সমাজতন্ত্র থেকে সরে উদার গণতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিল, তার সবটা তারা পায়নি। বদলে তারা অভাব আর বঞ্চনার অনুভূতিই পেয়েছে।

অবাধ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাত ধরে বাইরের শক্তিগুলো তাদের এ বঞ্চনার অনুভূতির সুযোগ নিয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছে। মস্কো তার শীতল যুদ্ধের সময়কার প্রোপাগান্ডা পদ্ধতি ব্যবহার করে খুবই চতুরতার সঙ্গে স্লোভাকদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। মস্কো তাদের মনে এ বিশ্বাস জন্মাতে সহায়তা করেছে যে সমাজতন্ত্র থাকাকালে তারা অনেক বেশি আরামে ছিলেন এবং একই ভাষাভাষী ও একই ইতিহাস-সংস্কৃতির স্লোভাকদের একসঙ্গেই থাকা উচিত।

এর মধ্যে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া, দারিদ্র্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি স্লোভাকদের মধ্যে রাশিয়াপন্থী আবেগকে উসকে দিচ্ছে। শুধু স্লোভাকিয়া নয়; বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরিতেও একই সমস্যা চলছে। এই বঞ্চনাবোধের কথাকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আমলে নিতে হবে। ইইউকে বুঝতে হবে পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে যে দূরত্ব রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে রাশিয়া তাদের মধ্যে ‘বিভক্তি তৈরি করো এবং জয় করো’ নীতি প্রয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার আরটি এবং স্পুতনিকসহ রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করলেও মস্কো সত্য-মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, তা ইইউ ঠেকাতে পারছে না।

যে অর্থনৈতিক সংকট এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হওয়া আন্তঃপ্রজন্মগত পরিবর্তন পূর্ব ইউরোপের মানুষকে ইউরোপবিমুখ এবং রাশিয়াপন্থী করছে, তা ঠেকাতে সমগ্র ইউরোপকে এগিয়ে এসে পূর্ব ইউরোপের পাশে দাঁড়াতে হবে। ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকেই রাশিয়ার আরটি এবং স্পুতনিকসহ রাষ্ট্রীয় চ্যানেল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করলেও মস্কো সত্য-মিথ্যা তথ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে, তা ইইউ ঠেকাতে পারছে না।

ইউরোপে অনেকেই মস্কোর হয়ে অর্থের বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মস্কোর পক্ষে মন্তব্য লিখছেন। বুলগেরিয়ায় সাবেক সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাঁর দেশে ক্রেমলিনপন্থী প্রোপাগান্ডা ছড়াতে পাবলিক ফিগারদের দুই হাজারের বেশি ইউরো দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রোপাগান্ডা ঠেকাতে ইউরোপকে সমন্বিতভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; অ্যালগরিদম বুঝতে হবে এবং কনটেন্ট মডারেশন বাড়াতে হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • সোনা মুজিকারোভা মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও স্লোভাক প্রজাতন্ত্রের উপপররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রীর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা