১৪ সেপ্টেম্বর যুগান্তর–এ একটা নিউজের হেডলাইন ছিল ‘অর্থনৈতিক সংস্কারে বেসরকারি খাতে দেশে বাড়বে মার্কিন বিনিয়োগ’। আমাদের এই অর্থনৈতিক সংস্কার কি ব্যাংক খাতের সংস্কার শুধু? ইউএনডিপির তথ্যমতে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাত পুরো অর্থনীতির ৭৮ শতাংশ এবং মোট চাকরির ৮৭ শতাংশ। অনানুষ্ঠানিক বা চুক্তিভিত্তিক ধরলে এই সংখ্যা ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি হবে। এবং সরকারের সংস্কার কমিটিতে এই অংশ নিয়ে কথাই হচ্ছে না। তাহলে আমরা কীভাবে এই সব বিনিয়োগ নিতে পারব?
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ১০০ দিন পূর্তি হিসেবে যে ভাষণ দিয়েছেন, সেখানে প্রবাসীদের বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। জুলাই বিপ্লবের ফলে অন্তত দেশের প্রবাসীরা এখন দেশের মানুষের সঙ্গে আগের থেকে অনেক বেশি সংযুক্ত। তাই এবার তাঁরা বিনিয়োগ করতে চান। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরাই সুযোগ খুঁজছেন বিনিয়োগের। বাস্তবে আমাদের কি তাঁদের জন্য সহজ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছি? বিডার নতুন চেয়ারম্যান অনেক নতুন আইডিয়া নিয়ে এসেছেন এবং উনি নিজেও বেসরকারি খাত থেকে সাহায্য চেয়েছেন। এত ‘মাথা ভারী’ প্রশাসন থেকেও উনি নিজের দুর্বলতা মেনে নিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের আমলাতন্ত্র বেসরকারি খাত বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না, ভবিষ্যতেও বুঝবে বলে মনে হয় না।
বেসরকারি খাতের সংস্কার দুই দিকে হতে হবে।
১. ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়ন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি
গত এক বছরে যতজন পরিচালক শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে, সবাই ধুঁকছেন তাঁদের ব্যবসা নিয়ে। আসল সমস্যা টাকার প্রবাহ। ব্যাংক টাকা দিচ্ছে না, যাদের কাছে টাকা পায়, তারা দিতে পারছে না, পারছে না সরকারও। এমনকি বাইরে থেকে যে বিদেশি ঋণ আসত, তা–ও কমে যাচ্ছে। সবাই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নিজে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। এভাবে কত দিন চালানো সম্ভব? এ ছাড়া ট্যাক্স, কাস্টমস সব ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা সব কাজকেই করে ফেলে কঠিন।
আমাদের উন্নয়ন সহযোগী বা এনজিওরা ‘বেসরকারি খাত সংযুক্তকরণ স্পেশালিস্ট’ নিয়োগ দেয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের সরকারি খাতে একেবারেই নেই। নিজেদের মতো করে বিভিন্ন আইন বানানো আর তার ফল এখন সারা দেশই বহন করছে। এদিকে এই বেসরকারি খাতের অনেকেই পতিত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে নিজদের অলিগার্ক বানিয়েছে। সরকারি আমলাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে অন্যদের ব্যবসা করতে দেয়নি, নতুন কোম্পানি ব্যবসা করতে পারেনি বা ছোট কোম্পানি খেয়ে ফেলা, সবকিছুই তারা করেছে। খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে, টাকা পাচার করে দেশকে ফোকলা বানিয়ে ফেলেছে। এদের জন্যই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ৬৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৬৮। বছরের প্রথম ৮ মাসে যেখানে ভিয়েতনামে বিনিয়োগ ১৪ বিলিয়ন ডলার, সেখানে আমাদের ১ বিলিয়ন ডলার ও না! আমাদের পুঁজিবাজার পুঁজি দিতে পারে না, নেই কোনো আস্থা। সব ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর তারাই ব্যাংক খাতকে নষ্ট করে এখন সব স্থবির করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি যদি ভবিষ্যতেও থাকে, তাহলে কীভাবে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব?
টিআইবি ২০ অক্টোবর একটা বিবৃতিতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং একটি টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে, বেসরকারি ব্যবসা খাতে শুদ্ধাচারচর্চার কৌশল (বিজনেস ইন্টিগ্রিটি স্ট্র্যাটেজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথরেখা নির্ধারণ অপরিহার্য।
প্রয়োজনে বিশেষ কমিশন গঠন করার আহ্বান জানায়, যা নিয়ে এখনো আসলে কিছু হচ্ছে কি না, দেখা যাচ্ছে না।
২. বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য আইন
দেশের মানুষ যে বেসরকারি খাতে চাকরি করছেন, তাঁদের জন্য কোনো আইন নেই। আছে শ্রম আইন এবং ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন। সরকারি অফিসের মানুষদের জন্য আইন আছে। কিন্তু বাকি ৯৫ শতাংশ এখনো জানে না কোন আইনে তারা সুবিধা পাবে। কিন্তু এই বিশালসংখ্যক বেসরকারি চাকরিজীবীদের মানোন্নয়নে সমাজ তথা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
শ্রম আইনে বেশির ভাগ আইন করে রাখা হয়েছে ঐচ্ছিক। কর্মকর্তারা কোনো সুবিধা পান না এ আইন দিয়ে। ফলে যা ইচ্ছা চুক্তি করিয়ে তাদের আটকে দেওয়া হয় চুক্তি আইন ১৮৭২–এর দোহাই দিয়ে। ব্যাংক বা কিছু ভালো মানের দেশি–বিদেশি কোম্পানির পলিসি আছে। কিন্তু বাকি যারা আছে বেশির ভাগেরই ন্যূনতম সুবিধা নেই। ফলে সরকারি আইন, পলিসি, পলিসিবিহীন কোম্পানি এবং শ্রম আইন দিয়ে একটা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। দুই দিনের ছুটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, ইনস্যুরেন্সের মতো প্রয়োজনীয় সুবিধা কারও আছে, বেশির ভাগেরই নেই। কিন্তু সবার জন্য ন্যূনতম একটা আইন করে দিলে কোম্পানিরা সেই আইনের আলোকে পলিসি তৈরি করলে এই বৈষম্য তৈরি হতো না। এই ক্ষোভ থেকেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গাতে বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। এই সরকার যদি উদ্যোগ না নেয় ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের কাছে সুবিধা পাওয়ার আশা আসলে করা সম্ভব নয়।
ডেইলি স্টার আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠান ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিনের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা’ এবং বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪ দুটি অনুষ্ঠানেই বেসরকারি খাত সরকারের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বাড়াতে চায় এবং সংস্কারকাজে সাহায্য করতে চায়। অনেক দিন ধরে দাবি তোলার পর এখন বেসরকারি খাত থেকে একজন উপদেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুরো সংস্কার ছাড়া সবকিছুই অপ্রতুল।
কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপের ২৭ জন রাষ্ট্রদূত প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসবেন। অন্যান্য দেশও আগ্রহ প্রকাশ করছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মতো ব্র্যান্ড খুলে দিতে পারে এই দেশের অপার সম্ভাবনা। আর এই সম্ভবনাকে দ্রুত গ্রহণ করতে আমাদের দরকার সংস্কার, যা এখনই করতে হবে। বিগত সংসদে ৬৭ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্ব এলে এই কাজ আটকে যেতে পারে।
এই সংস্কার শুধু সরকারি আমলা দিয়ে হবে না, বেসরকারি খাতের মানুষ, আইনজ্ঞ ও গবেষকদের মিলিতভাবেই করতে হবে। যুগে যুগে নতুন নতুন অলিগার্ক দেখতে চাই না, তেমনি নিষ্পেষিত চাকরিজীবীদেরও দেখতে চাই না আর। আর তাই সবাই এই সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: [email protected]