শিক্ষার্থীর ভোগান্তি, শিক্ষকের দায়

ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী। বেঁচে থাকলে একদিন আইনজীবী বা বিচারক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হতো। পিতৃহীন সংসারের হাল ধরত সে, নিজের ছোট ভাইটাকে দেখে রাখত। তার আত্মহত্যার খবর জেনে অন্য অনেকের মতো আমি মর্মাহত হয়েছি। তার মায়ের আহাজারি শুনে এই বেদনা আরও বেশি অনুভব করেছি।

অবন্তিকার এই মৃত্যু আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রশাসন, ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতি, সমাজের মানসিকতা প্রসঙ্গে বহু ন্যায্য প্রশ্নের পুনরুত্থান ঘটিয়েছে। আমি সেসব নিয়ে নিজের উপলব্ধির কথা বলব। কিন্তু তার আগে বলে রাখি, অবন্তিকার আত্মহনন যত বেদনাদায়কই হোক, এটি সমর্থনীয় নয়। কোনো কারণেই একজন শিক্ষার্থীর আত্মহননের দিকে যাওয়া উচিত নয়।

এ কথা জোর দিয়ে বলছি; কারণ, আমিও নানা বঞ্চনা, নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। এর কিছু বর্ণনা আমার পিএইচডির গল্প বইয়ে দিয়েছি, কিছু কথা নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার রূপান্তর ঘটে, তখন আবার প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কারণে কিছু শিক্ষকের রোষানলে পড়তে হয়েছিল।

কিন্তু আমি আত্মহত্যার কথা ভুলেও ভাবিনি তখন। আমাদের তরুণকালে এমন ঘটনা আদৌ ঘটত বলেও মনে পড়ে না। আমি জানি, এখনকার সময়ে যারা আত্মহত্যা করে বা করার কথা ভাবে, তাদের জীবনে হয়তো আরও গুরুতর ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারপরও কোনো অবস্থায় আত্মহত্যা করা যাবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন কোনো ১০০ মিটার দৌড় নয়, জীবন বরং ম্যারাথনের মতো। স্বল্প সময়ে বহু বঞ্চনার জীবন পরে আনন্দ আর সাফল্যে ভরে উঠতে পারে। আত্মহত্যা শুধু নিজের সম্ভাবনাময় জীবন নয়, নিজের মা–বাবা ও পরিবারের স্বাভাবিক জীবনের মৃত্যু ঘটায়। আমরা অবন্তিকার মায়ের আহাজারি দেখেছি, মনে হয় না মায়ের এমন প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবলে অবন্তিকা আত্মহত্যা করতে পারত।

আত্মহত্যা না করে বরং আরও প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ভালো ও পরোপকারী কিছু শিক্ষক থাকেন, তাঁদের সাহায্য নিতে হবে। সর্বোপরি নিজেকে আরও শক্তভাবে গড়ার চেষ্টা করতে হবে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রী যৌন হয়রানির সম্মুখীন হয়েছিল, সে অবিচল থেকে আজ একজন বিচারক হিসেবে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে এ জন্য দায়ী ছিল, তাকে একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়েছিল। সব সময় এটা হবে, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু অবন্তিকাই যদি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করত, তার সুযোগ হতো আইনজীবী হয়ে তাকে হয়রানি করা মানুষদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার বা এ ধরনের ভিকটিমদের পক্ষে কোনো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানে কাজ করার।

আমরা যারা ধর্মবিশ্বাসী মানুষ, আমাদের এটাও মনে রাখা উচিত, পৃথিবীর সব ধর্মে আত্মহত্যাকে মহাপাপ হিসেবে দেখা হয়। যাঁরা ধর্মের কথা ভাবেন না, তাঁদের মনে রাখা উচিত, এটি সামাজিক নৈতিকতায়ও অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য (এ জন্য এর চেষ্টা করা আইনশাস্ত্রেও শাস্তিযোগ্য) কিছু।

দুই.

আমি এতক্ষণ এক পক্ষের কথা বললাম। যারা আমাদের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়, এবার তাদের কথা বলি। শিক্ষক বা সহপাঠী বেশে এমন কিছু দুর্বৃত্ত আছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়, বিচার হয় কালেভদ্রে, হলেও শাস্তি হয় নামমাত্র। দুই দিন আগেই প্রথম আলোয় পড়লাম নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি করার জন্য দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের শাস্তি হয়েছে। শাস্তি হচ্ছে—তিনি দুই বছর ক্লাস ও পরীক্ষা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ তিনি বিনা কাজে বসে বসে দুই বছর বেতন পাবেন! দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনি পরামর্শ নেওয়ার অফিস বা ব্যবস্থা রয়েছে। কখনো শুনিনি, তদন্তে প্রমাণিত যৌন নির্যাতকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে ভিকটিমকে সাহায্য করা হয়েছে এই অফিসের মাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেরা যে বিচার করে, সেটিও অনেক সময় হয় মুখচেয়ে। যৌন হয়রানির জন্য অভিযুক্ত শিক্ষক যদি সরকারপন্থী হয়, তাহলে তাকে কখনো কখনো নানা কৌশলে রেহাই দেওয়া হয় বা মৃদু শাস্তি দেওয়া হয়। তাদের কেউ সরকারি আনুকূল্যে বড় পদে নিয়োগ পান, এমনকি এই ঘটনাও ঘটে। চাকরিচ্যুতির মতো বড় শাস্তি প্রদান করা হয় কেবল ভিন্নমতের শিক্ষক হলে (অভিযুক্তজন সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী হলেও অপরাধটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, এতে নেতার সঙ্গে কখনো সহযোগী হন শিক্ষকও)।

অবন্তিকার মৃত্যুর পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক কর্তৃক মাইনাস বা নেগেটিভ মার্কিংয়ের ঘটনাও এখন জনসমক্ষে এসেছে। কম হলেও এমন ঘটনা ঘটে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। আমার জানামতে, যেসব কারণে কিছু শিক্ষক মাইনাস মার্কিং করেন, তার মধ্যে রয়েছে ক. শিক্ষকের দেরি করে আসা, ক্লাস না নেওয়া, ঠিকমতো না পড়ানো বা তার বুলিংয়ের প্রতিবাদ করা, খ. শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির বিপক্ষে অভিযোগ করা, গ. শিক্ষকের খামখেয়ালিপূর্ণ আচরণে (যেমন সুদীর্ঘ সময় বা অসময়ে ক্লাস নেওয়া) আপত্তি করা।

এই অন্যায় যারা করে, তাদের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু তারপরও এটি অত্যন্ত গুরুতর পরিণতি বয়ে আনতে পারে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে। কোনো শিক্ষক সম্পর্কে এমন প্রতিহিংসাপূর্ণ আচরণের মিথ ছড়িয়ে পড়লে তার সব অন্যায় ছাত্ররা সামষ্টিকভাবে মেনে নেয়। আবার শুধু এমন একজন শিক্ষক রুষ্ট হলে একজন শিক্ষার্থীর পুরো রেজাল্টে শোচনীয় প্রভাব পড়তে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড এক্সামিনার থাকে বলে কিছুটা রক্ষা। কিন্তু সেখানেও কোর্স শিক্ষকের কাছে এককভাবে কিছু নম্বর (আমাদের আইন বিভাগে ৩০) থাকে বলে, তিনি চাইলে প্রতিহিংসাবশত কোনো শিক্ষার্থীর রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দিতে পারেন। বাকি দশজন দায়িত্ববান শিক্ষকের মূল্যায়ন তিনি একাই কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারেন।

তিন.

এগুলো মাঝেমধ্যে হয়, আমরা তা জানি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বেশি হলে তার লেজ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যেমন ক. বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি দমন কমিটিগুলোয় অভিজ্ঞ মানবাধিকারকর্মী বা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের রাখা, খ. যৌন হয়রানি বা অন্য কোনো অভিযোগ করা ছাত্রীকে সাহস ও সহায়তা দেওয়া, গ. ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর শিক্ষকদের নম্বরপত্রগুলো নিরীক্ষা করা। অন্যদের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে কোন শিক্ষক অস্বাভাবিক বেশি বা কম নম্বর দিলে তা তদন্ত করা, গ. অবশ্যই ছাত্রছাত্রীদের কর্তৃক শিক্ষকদের মূল্যায়ন চালু করা। চাইলে বিভিন্ন পরামর্শ সভা করে আরও পদক্ষেপের কথা ভাবা যায়।

আমরা আমাদের শিক্ষকদের নিম্ন–বেতন ও সুবিধাদির অভিযোগ করি। এটি সত্যি, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় এ দেশে শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। কিন্তু বেতন ও সুবিধাদির পাশাপাশি আমাদের জবাবদিহি বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। আমরা কে না জানি, জবাবদিহিহীন ক্ষমতা হচ্ছে সব অন্যায়ের ভিত্তি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগকারী একজন ছাত্রী আর তার শিক্ষকদের সালিস হয়েছে পুলিশের কার্যালয়ে। আমরা শিক্ষকেরা নিজেরা দায়িত্ববান না হলে এর চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটতে পারে ভবিষ্যতে।

  • আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক