সংকোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে শিক্ষার্থী পাবে কি প্রকাশের দূরন্ত সাহস

শিক্ষা অনেক কিছুই করে। আচরণের স্থায়ী পরিবর্তন করার কথাটাই শিক্ষিত মহলে সবচেয়ে বেশি চাউর হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ উদ্ভূত যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ও প্রস্তুত থাকার সক্ষমতাও মানুষ শিক্ষা থেকেই অর্জন করে।

বাংলাদেশে আমরা কী দেখি! দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ যেন চরম অপ্রস্তুতির মধ্যে আটকে থাকে। যেকোনো নতুন পরিস্থিতি দেখা দিলেই হতবিহ্বল ও অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়াই যেন আমাদের প্রধান কাজ।

হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটক আছে। সেখানে দেখি এক গাতক চরিত্র। এলাকায় তার খুব খ্যাতি। খবর জেনে কোনো একটা টিভি চ্যানেল আসে। ওই ব্যক্তিকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে যখন কিছু বলতে বলা হলো, দেখা গেল, তিনি উন্মাদ-উদ্‌ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থাকছেন।

কোনো কথা বলতে পারছেন না। গান গাইতে বললে বহুবার গাওয়া গানটিও তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। অনেক চেষ্টা-আত্তি করে খানিক পরপর বলে ওঠেন, ‘ওরে তোরা আয়!’ আসলে গানটা ছিল কাজী নজরুল ইসলামের বহুশ্রুত সেই গান—‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।’ লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন; হতবিহ্বল হয়ে গেছেন। সংকোচের বিহ্বলতায় আক্রান্ত হয়ে চিরকাল গাওয়া গানটিও গাইতে পারলেন না। কথা বলা তো বহুত দূর অস্ত!

ওই ব্যক্তির অবস্থা না-বুঝে মুখস্থবিদ্যায় পরিদর্শী বিদ্যার্থীর মতো। এই বিদ্যা বিদ্যার্থীর চিন্তা, যাপন, কর্ম আর প্রাণস্ফূর্তির সঙ্গে সব সময় যুক্ত হতে পারে না। না-বুঝে মুখস্থবিদ্যার প্রধান কাজ ‘ভালো ফল’ করানো। বিদ্যার্থীর দেহ-মন সুবাসিত করার প্রতিশ্রুতি এই বিদ্যা দেয় না। বলে রাখা ভালো, সব শিখনপদ্ধতিতেই শিক্ষার্থীকে কিছু না কিছু মুখস্থ করতেই হয়। সব শিক্ষাব্যবস্থাতেই মুখস্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মুখস্থ আর না-বুঝে মুখস্থনির্ভরতা এক জিনিস নয়।

স্মৃতি বা মুখস্থনির্ভর প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কী অবস্থা দাঁড়ায়? প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা ও শিখনপদ্ধতি অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ক্রমে আবিষ্কার করতে শেখায়, সে ভালো ছাত্র নয়। সে গড়পড়তা বা পেছনের সারির। ক্লাসের স্মৃতিধর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকারীদের নিয়ে ভাবনায় আকুল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এটা অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষার্থীর জন্য গ্লানিকর। একধরনের মানসিক নির্যাতনও বটে। ক্রমাগত এই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক কাঠামোগত নির্যাতনের ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে অধিকাংশ বিদ্যার্থী। একসময় তারাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হয় রাষ্ট্রের বিচিত্র কাজের সঙ্গে এবং পরবর্তীকালে একেকজন মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ সার্ভিস প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় গেলে এর প্রমাণ পাওয়া যায় হাতেনাতে।

স্মৃতিমুখ্য পড়াশোনার আরও ব্যাপার আছে। স্মৃতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা হারিয়ে যায়। ফিকে হয়ে যায়। পুরোনো স্মৃতি মুছে গিয়ে নতুন নতুন স্মৃতিই মানুষকে বেশি পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আর পরীক্ষা পাসের জন্য মুখস্থের স্মৃতি হলে তো কথাই নেই। বিগত শ্রেণির পড়াশোনার স্মৃতি বার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিনেই ভুলে যায় শিক্ষার্থীরা। কারণ, তাকে আবার নতুন শ্রেণিতে মুখস্থ করতে হয় রাজ্যের নতুন নতুন বিদ্যা।

এ ধরনের বিদ্যাব্যবস্থা যেকোনো মানুষকে জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত আর বিহ্বল করবেই। এ কারণে আমরা লক্ষ করি, আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষদের একটা বড় অংশ অধীত পড়াশোনার স্মৃতিরহিত। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার বেদনায় আক্রান্ত। প্রকাশের সংকোচ ও অপ্রস্তুত মানসিকতা তাদের অনেক অনেক মানবিক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক এ জায়গাতেই হাত দিয়েছেন। বলেছেন, ‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।’ ‘নতুন কারিকুলামের’ অন্য অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এ সংকোচের বিহ্বলতা থেকে মুক্ত করা।

কিছুদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু স্কুল পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ল ছেলেমেয়েদের ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। অনেকে বলবেন, দক্ষিণ কোরিয়া আর বাংলাদেশ এক নয়। আমি শুধু বলব, প্রকাশের অক্ষমতা, সংকোচের বিহ্বলতা সবখানেই অনভিপ্রেত। চলমান কারিকুলামকে বলা হচ্ছে ‘নতুন কারিকুলাম’। কিন্তু সারা দুনিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটি একেবারেই নতুন নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গায় এই কারিকুলাম বা এর খুব কাছাকাছি শিখনচেতনার কারিকুলাম চালু আছে বহুকাল থেকে। তবে বাংলাদেশে নতুন বটে!

এই কারিকুলামের প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীকে নিজের দিকে তাকানোর অবসর দেওয়া। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপযোগী করে তোলা এবং অবশ্যই নিজেকে আবিষ্কার করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এই কারিকুলামের দর্শনের কেন্দ্রীয় দর্শন শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষিতকরণ। এর রূপরেখায় বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে তোলাই এর উদ্দেশ্য। যোগ্যতার চারটি উপাদান—‘মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা ও জ্ঞান’—মাথায় রেখে কারিকুলামটিকে সাজানো হয়েছে। এই উপাদানগুলো নতুন শিখনপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারবে বলে নতুন কারিকুলাম–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।

যোগ্যতা নানাভাবে অর্জন করা যায়। কিন্তু নতুন কারিকুলামে যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিখনপদ্ধতির মধ্যে দলগত অংশগ্রহণের ব্যাপারকে একটা বড় স্থান দেওয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত প্রেজেন্টেশনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে শারীরিক-মানসিক সক্রিয় অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে। ইন্দ্রিয়মুক্তিও এই কারিকুলামের একটা বড় দিক।

এই কারিকুলাম শিক্ষার্থীকে ঘাড় গুঁজে ঘরের কোনায় টেবিলে একা পড়া থেকে মুক্তি দিতে চায়। ফলে শিক্ষার্থীকে আবশ্যিকভাবে অনেকের মধ্যে নিজেকে স্থাপন করতে হবে। অনেকের মধ্যে নিজেকে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিসহ স্থাপন ও নিজস্ব ভাবনাকে ভাষা দিতে পারাকেই তো নিঃসংকোচ আত্মপ্রকাশ বলে।

নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। এটি থাকবেই। কারণ, অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত পথে চলতেই আরাম বোধ করে। নতুনকে গ্রহণ করতে গেলে মানুষ অনিশ্চয়তা, সংশয়, এমনকি ভীতিও বোধ করে। এগুলো কাটিয়ে নতুন সময়কে ধারণ করা ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলার নামই তো প্রগতি। প্রগতি এক দিনে আসে না; ক্রমে আসে।

কুদরত-ই-হুদা উপপরিচালক, ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিম, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর

[email protected]