ব্রাজিলের বেলেমের সিটি পার্কের ‘হ্যাঙ্গার কনভেনশন অ্যান্ড ফেয়ার সেন্টার অব দ্য আমাজন’ এবং ‘ওয়ালডেমার হেনরিক থিয়েটার’–এ শুরু হয়েছে জলবায়ু সম্মেলন।
আমি আছি শহরের বারবোসা নামের একটা বাড়িতে ২৪ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বাসে সম্মেলনস্থলে আসতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে যায়। সম্মেলনের তৃতীয় দিন ১২ নভেম্বর বাসেই পরিচয় হয় তানজানিয়ার জেরমান কোয়াঘে সিডোইয়েকার সঙ্গে। পশুচারণজীবী দাতুগা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। জেরমান জানতে চাইলেন বাংলাদেশের কথা।
দক্ষিণ এশিয়ার এক বৃহৎ গোচারণভূমি সিরাজগঞ্জ-পাবনার বাথানের কথা জানালাম। যমুনা অববাহিকায় গড়ে ওঠা ১ হাজার ৬০০ একর বাথানের (তথ্যটি স্থানীয়দের ধারণামতে) গোহালা ও ধলাই নদ–নদীর মৃত্যু, পানির কষ্ট, তাপপ্রবাহ আর বছর–বছর বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বাথানের আলাপ শুনে জানালার কাচে হাত রেখে কোথায় যেন তাকালেন জেরমান। বললাম, বাথানের সব গরুর নাম আছে, বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকার নামে। বাথানের গরুরা রাখালদের ভাষা বোঝে, গরুরাও রাখালদের কথা শোনে।
জেরমান জানান, দাতুগা আদিবাসীরাও গরু-ভেড়ার ভাষা বোঝে। ১০টি গোত্রে বিভক্ত এই যাযাবর জনগোষ্ঠী বছরজুড়ে গবাদি প্রাণীর পাল নিয়ে ঘোরে। কয়েকজন প্রবীণ কুকুর নিয়ে যাচ্ছিলেন রাস্তায়, বাসটা কষে ব্রেক করায় একটা ঝাঁকুনি হলো।
জেরমান আবার শুরু করে, কিন্তু দাতুগারা আর আগের মতো পশুচারণজীবী থাকতে পারছে না। বহু তরুণ কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাচ্ছে অচেনা শহরে। দিন দিন ‘রুফতা মানাং’ বাড়ছে। মানে অনাবৃষ্টি আর অকাল বর্ষণ। এ কারণে তাদের আরুশা অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে ‘গেউইয়েদা’ মানে তীব্র খরা। প্রতিদিন দলের নারী-পুরুষ-শিশুদের প্রায় ১৫ কিলোমিটার হেঁটে পানি আনতে হয়। ৬–৭ ঘণ্টা চলে যায়। জেরমান বলেন, গরুগুলোকে তো আর পানি না দিয়ে রাখা যায় না, তারা আমাদের পরিবারের সন্তান।
বাস চলে আসে, আমরা নেমে পড়ি। সম্মেলনস্থলে প্রবেশের মুখেই প্রতিবারের মতো এবারও প্রাণিজ খাবারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ‘ভেগান কর্মীরা’। ব্যানারে লিখেছেন, ‘বহুজাতিক মাংস উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী, প্রাণীরা আমাদের খাদ্য নয়, বন্ধু’।
নিরাপত্তা তল্লাশির কাজ শেষ করতে করতে জেরমান বলেন, গরু-ভেড়াদের নিয়ে কোনো আলাপ নেই জলবায়ু সম্মেলনে, যেন তারা সংকটের বাইরে, অথচ প্রাণী আর আমাদের জীবন একসঙ্গে বাঁধা। কারোর জীবন–জীবিকা প্রাণিসম্পদের ওপর নির্ভরশীল, আবার কেউ করপোরেট প্রাণিজ খাদ্যের বিরুদ্ধে যুক্তি-প্রমাণসহ দাঁড়াচ্ছেন। ভাবি দুনিয়াজুড়ে শতসহস্র জটিল জিজ্ঞাসা আর তর্কগুলো কখনো কি জলবায়ু মঞ্চে সমান মর্যাদায় জায়গা পাবে?
দুনিয়াজুড়ে ‘জেতেরদে’ বদলাচ্ছে
ক্যামেরুনের কৃষক-পশুচারণজীবীদের নিয়ে কর্মরত অ্যাম্বাসকুডা নেটওয়ার্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুসা উসামা দাম্বার সঙ্গে আলাপ হয়।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ১১ নভেম্বর সন্ধ্যার আলাপে দাম্বা জানান, ৩০টি ছোট–বড় সংগঠনের জোট আছে তাঁদের। সবাই গ্রামীণ কৃষক ও যাযাবর পশুচারণজীবী। চেফিরি কোলবং এলাকার সিঙ্গা গ্রামে এমবরুরু জনগোষ্ঠীর দাম্বার বাড়ি। এমবরুরু জাতিগোষ্ঠী সম্পূর্ণ যাযাবর নয়, বর্ষাকালে প্রাণিসম্পদ বহর নিয়ে গ্রামে কাটায়। আগের দিনে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ছিল গ্রীষ্মকাল। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে তাপ বেশি থাকত।
প্রাণিবহর নিয়ে নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরজুড়ে গ্রামের মানুষেরা বেরিয়ে পড়তেন বাৎসরিক ‘জেতেরদে’ যাত্রায়। জেতেরদের আগে প্রবীণেরা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের নানা পরীক্ষা করতেন। কর্ডি (তারা) এবং বাতাসের গতি পরীক্ষা করে জেতেরদে যাত্রা এবং ফেরার সময় নির্ধারিত হতো। কবে বৃষ্টি হবে আন্দাজ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে এই আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
অবিশ্বাস্য তাপ বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাত কোনো কাল মানছে না। জেতেরদে থেকে বাড়ি ফেরার আগেই বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। আবার বৃষ্টিহীনতার কারণে গরুর খাদ্য উৎস কমছে। দুধ ও মাংসের উৎপাদন কমছে। রোজগার কমছে। সামাজিক দ্বন্দ্ব–সংঘাত বাড়ছে। বহরের মায়া ও দায় ছেড়ে বহু তরুণ জীবিকার খোঁজে হারিয়ে যাচ্ছে দূরের অজানা শহরে।
এমবরুরুদের বদলে যাওয়া জেতেরদে যাত্রার আলাপ শুনে বাংলাদেশের মৌসুমি বাথান কিংবা বেদে-মাঙতা জনগোষ্ঠীর নিদারুণভাবে বদলে যাওয়া ‘পরবাস’ যাত্রার কথা মনে পড়ল। বাৎসরিক সেই সব পরবাস যাত্রায় কেবল জমি ও নদী-মৃত্যু নয়, জলবায়ু সংকটের ক্ষতচিহ্নও আছে।
বাংলাদেশজুড়ে আজ চারণভূমি লোপাট হয়েছে। শাহজাদপুরের বাথান, সুনামগঞ্জের দেখার হাওরের গোপাট কিংবা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ইছাখালীর চরের মতো ঐতিহ্যবাহী চারণভূমি আজ বিপন্ন। পাহাড়ি ঢল, লবণাক্ততা, বন্যা, ভাঙনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় বা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত। ভোলা বা নোয়াখালীর উপকূলচরে মহিষদের বিচরণ এলাকা ও স্থানান্তরকাল বদলাচ্ছে। গবাদি প্রাণিকুলের ওপর তৈরি হওয়া জলবায়ু আঘাত মোকাবিলায় এখনো বৈশ্বিক কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত হয়নি।
মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রথম অংশগ্রহণ
প্রথমবারের মতো জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ৪ নভেম্বর ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে এ উপলক্ষে একটি প্রস্তুতিমূলক কর্মশালা আয়োজন করে তারা। কর্মশালায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, কেবল ভালনারেবিলিটি নয়, বরং বাংলাদেশের শক্তিকেও বিশ্বের সামনে আনতে হবে। সব মন্ত্রণালয়সহ সবক্ষেত্রের সবাই মিলে দেশের জন্য কপে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিরুদ্ধ জলবায়ুর সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার যোগ্যতা থাকলেও চারণভূমির মতোই বাংলাদেশে নিখোঁজ হয়েছে দেশি প্রাণিসম্পদের বৈচিত্র্য। হাইব্রিড গরুদের বন্দী করে দশাসই হয়েছে মাংস আর দুধের জোগান। বজ্রপাতের কারণে প্রাণী মৃত্যুর হার বাড়ছে। গ্রাম থেকে রাখালপ্রথা উঠে গেছে। দুধের সন্দেশের জন্য বিখ্যাত সাতক্ষীরায় তীব্র লবণাক্ততার কারণে একমুঠো ঘাস মিলছে না কোথাও। তাপপ্রবাহে নিত্যনতুন অসুখ বাড়ছে প্রাণিসম্পদের।
উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বিখ্যাত মৎস্যবিচরণ অঞ্চলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত। মাছের ডিম পাড়ার পরিবেশ ও সময়কাল বদলাচ্ছে। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ৪৯ দশমিক ৯২ লাখ মেট্রিক টন মাছ, ১৬৩ দশমিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন দুধ, ৮৫ দশমিক ১০ লাখ মেট্রিক টন মাংস ও ২২৩৯ দশমিক ৩০ কোটি ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে জলবায়ু আঘাত, অর্থায়ন, স্থানীয় অভিযোজন, প্রাণিকল্যাণ অধিকার কিংবা নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজের আলাপে বাংলাদেশ কতখানি সরব থাকবে?
ন্যায্য রূপান্তর বিতর্ক এবং হারানো মহেশ
কার্বন নির্গমন হ্রাসের রাষ্ট্রীয় কৌশলপত্র হিসেবে বাংলাদেশ ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি)’ প্রতিবেদনে ‘ন্যায্য রূপান্তরের’ অঙ্গীকার করেছে। দেশীয় প্রাণিকুল, বাথান, নিরাপদ প্রাকৃতিক গোখাদ্য কিংবা গ্রামীণ নারীর লোকায়ত ব্যবস্থাপনার অগ্রাধিকার ছাড়া কি প্রাণিসম্পদের ন্যায্য রূপান্তর সম্ভব? নাকি ‘লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের’ জন্য বহুজাতিক কোম্পানির প্রাণিসম্পদ বাণিজ্যই জারি থাকবে? জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট’ সংক্ষেপে ইফাদের প্রতিনিধি পিটারনেল বুগার্ড ১১ নভেম্বর ব্লু-জোনে আয়োজিত ‘ফ্রম প্লেজ টু প্র্যাকটিস: ডেলিভারিং ক্লাইমেট ফিন্যান্স ইন ভালনারেবল সিচুয়েশন’ শীর্ষক এক আলোচনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লোকায়ত অভিযোজনের ক্ষেত্রে অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দেন।
১২ নভেম্বর কৃষি, বৈশ্বিক অভিযোজন লক্ষ্যমাত্রা এবং জ্বালানি খাতের ন্যায্য রূপান্তর নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা হয়। খাদ্য ও কৃষি প্যাভিলিয়নের আলাপে মাটির কার্বন বাড়াতে প্রাকৃতিক উপায়গুলো ঠিক রাখা, কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, কৃষকের সক্ষমতা, বনভূমির পুনরুদ্ধার, কার্যকর পূর্বাভাস, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের সহযোগিতার পাশাপাশি কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়।
১২ নভেম্বর কমনওয়েলথ আয়োজিত এক অধিবেশনে এন্টিগুয়া ও বারবুডার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর জলবায়ু-দূত রুয়েলা কেমাচো থোমাস দ্রুততম সময়ে জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করার দাবি করেন। রুয়ান্ডার পরিবেশমন্ত্রী ড. বার্নাডেটি আরাকুয়ে স্থানীয় উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিয়ে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ঔপনিবেশিকতা, বৈষম্য আর ক্ষমতার বাহাদুরি নয়া চেহারায় জারি আছে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে অচেনা সব জলবায়ু আঘাত। গফুররা হয়তো পালাতে পারে, কিন্তু মানুষের পৃথিবীতে মহেশরা কোথায় পালাবে? মানুষের পাতানো জলবায়ু মঞ্চে কি এর জবাব পাওয়া যাবে?
বাকুতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কপ২৯–এর প্রেসিডেন্ট আজারবাইজানের প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী মুখতার বাবায়েভ বলেন, অর্থায়ন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, জেন্ডারবান্ধব, আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠী নির্ভর এবং জনগণকেন্দ্রিক হতে হবে। মরিশাসের পরিবেশ, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জিয়ান্নি লান হিং পু বলেন, ন্যায্য রূপান্তর কেবল পরিবেশের প্রশ্ন নয়, এটি সামাজিক, ন্যায্যতা এবং অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় অভিযোজন কৌশল সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে পারে।
সম্মেলন থেকে দেওয়া পানির বোতলে জার থেকে পানি ভরতে গিয়ে নামিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের ওমাহেকি রিজিয়নের বান্দেরো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কৃষক ফানুয়েল ওপেরি মুরাঙ্গির সঙ্গে আলাপ হয়। কালাহারি মরুভূমির এই অংশে খরা আর অনাবৃষ্টির সঙ্গে বাড়ছে ঝোপের আগুন। প্রাণী পালন কঠিন হয়ে পড়ছে।
রাতে বাসে ফিরতে ফিরতে মনে আসে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পের কথা। কৃষক গফুর, তার মেয়ে আমিনা আর তাদের গরু মহেশ। গ্রামের অত্যাচারী জমিদার গোচারণভূমিটি বেচে দিয়েছিল। মহেশের কোনো মাঠ ছিল না, খাবার ছিল না। এর ওপর বন্যা আর খরার কারণে গফুরদের অবস্থা আরও করুণ হয়ে ওঠে। শোকে–ক্ষোভে মহেশকে মেরে গ্রাম ছেড়ে গফুর শহরে চটকলে কাজ নেয়। দুনিয়াজুড়ে গফুর, আমিনা আর মহেশরা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ঔপনিবেশিকতা, বৈষম্য আর ক্ষমতার বাহাদুরি নয়া চেহারায় জারি আছে। এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে অচেনা সব জলবায়ু আঘাত। গফুররা হয়তো পালাতে পারে, কিন্তু মানুষের পৃথিবীতে মহেশরা কোথায় পালাবে? মানুষের পাতানো জলবায়ু মঞ্চে কি এর জবাব পাওয়া যাবে?
● পাভেল পার্থ লেখক ও গবেষক। ই মেইল: [email protected]