ড. কামাল হোসেন এবং ইতিহাসে তাঁর স্থান

ড. কামাল হোসেন

আমরা যারা কম-বেশি দেড় দশক হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস করছি, তাদেরও সৌভাগ্য হয়েছে তাঁকে দেখার। সহযোগীবেষ্টিত হয়ে ধীর কিন্তু দৃপ্ত পায়ে যখন আদালতের দীর্ঘ করিডর দিয়ে হেঁটে যান, তখন মনে হয় হেঁটে যাচ্ছেন একজন ইতিহাসের সাক্ষী (আসলে ইতিহাসের নির্মাতাদের একজন)।

কোর্ট রুমে যখন জটিল সাংবিধানিক প্রশ্নের কোনো ‘ইলাস্ট্রিয়াস’ সাবমিশান দেন, তখন মনে হয় সংবিধান নামক জাতির অভিজ্ঞানগ্রন্থের কোনো সরল পাঠ নিচ্ছেন সেই সংবিধানের প্রধান রচয়িতা স্বয়ং। আমাদের জন্য এ এক অভিজ্ঞতা বটে। এমন একজন মহান ব্যক্তির সম্মানে লিখতে কোনো উপলক্ষের প্রয়োজন নেই, তারপরও এমন ক্ষণজন্মার জন্য জন্মদিন একটা উপলক্ষ বৈকি আজ। তাঁর ৮৭তম জন্মদিন। অভিবাদন মায়েস্ত্রো।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের সীমানার কথা ভাবলে দেখা যায়, আমাদের সেই সাংস্কৃতিক ভূগোলে ড. কামাল হোসেনের পরিচয় কোনো নির্দিষ্ট অভিধায় সীমায়িত করা খানিকটা অনিশ্চয়তাযুক্ত। এর কারণও তিনি নিজেই। তিনি কি আইনজ্ঞ নাকি রাজনীতিক, (যদিও এখন ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন) নাকি সংবিধানবেত্তা?

ড. কামাল হোসেন কি কেবলই দর্পিত আইনজ্ঞ, নাকি ঐতিহাসিকভাবে নির্বাচিত কোনো নায়ক? যদি ‘স্ট্রাকচার্ড পলিসেমি’ ব্যবহার করে তাঁকে নতুন অভিধায় ভূষিত না–ও করি, তথাপি নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি ‘ব্যক্তির অতিরিক্ত’ এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের এক নতুন সময়ের প্রচ্ছদপট। সংবিধান রচনার প্রাক্‌–মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তাঁর একটি আন্তরিক ‘হ্যাঁ’ আসলে গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞ করে রাখল।

জন্মস্বত্বে ছিলেন অসামান্য মেধার অধিকারী। কিন্তু এই অসামান্য মেধা তাকে শ্রমবিমুখ করেনি; বরং শ্রমলব্ধ সব প্রকল্পের অবিকল্প অংশ ছিলেন ড. কামাল। তাঁর অধীত আইনে দক্ষতা এনসাইক্লোপিডিয়া ধরনের। যার মূলধন চূড়ান্ত যুক্তিশীলতায় পরিপূর্ণ, নিজস্ব ভাবনা ও অন্তর্দৃষ্টিতে জারিত, তবে তাতে বাঙালিসুলভ একমুখিনতা নেই। নেই অপ্রয়োজনীয় ভাবাবেগ ও পাণ্ডিত্যশ্লাঘা। তাঁর বৈদগ্ধ্যের ভেতরে রয়েছে প্রজ্ঞার বিভিন্ন পরত।

দেশে শিক্ষা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার পর ইন্ডিয়ানার নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর অসাধারণ একাডেমিক রেকর্ড দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, এই মানের ছাত্রকে তৃতীয় বর্ষে ভর্তি করা যায়; সুতরাং বালক কামাল হোসেন শুরু করলেন তৃতীয় বর্ষের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী হিসেবে। তাঁর সহপাঠীদের বয়স যেখানে ১৮-১৯, তিনি সেখানে মাত্র ১৬ বছরের তরুণ।

ড. কামাল হোসেন চিন্তা ও কর্মের বেশির ভাগ জুড়েই অনিবার্য রেফারেন্স বঙ্গবন্ধু। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আলাপে বঙ্গবন্ধুর উল্লেখ থাকেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পূরণ না হওয়ার কষ্ট তাঁকে পীড়িত করে। তাঁর দুঃখ বঙ্গবন্ধু এখন কেবলমাত্র ব্যানার–পোস্টার আর কায়েমি স্বার্থান্ধদের ব্যবহারের বিষয়।

অবরুদ্ধ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বরহিত এক দেশের সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবেই কি না, পিএইচডির বিষয় নির্বাচনে  কামাল হোসেন বেছে নেন ‘স্টেট সভরেন্টি অ্যান্ড ইউনাইটেড নেশনস চার্টার’।

তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এটার জন্য আমি স্যার হামফ্রির কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি যেভাবে আমাকে সুযোগটা করে দিলেন, ভাবাই যায় না। একান্ত ভূমিপুত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জমিজিরাত, তাঁর মানসসংস্কৃতি আর তাঁর অস্মিতা যেন করদ করে রেখেছে অবাঙালিরা। অতএব, ২০ শতকের বাঙালি পুরুষকে জাগতে হবে, তারই এক প্রতিভূ ড. কামাল হোসেন।’

ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইত্তেফাক মামলাসহ কিছু বিখ্যাত মামলা পরিচালনা করে তরুণ বয়সেই দুই পাকিস্তানেই আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি পান, যার ফলে ১৯৬৭, ৬৮ ও ৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পান। ’৭১ সালে তিনি যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দী, তিনি তখন সিটিং ভাইস চেয়ারম্যান অল পাকিস্তান বার কাউন্সিলের। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্য সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন, ‘‘‘তুমি ভাইস চেয়ারম্যান। বার তুমি ভালো বোঝো, তুমি বার কাউন্সিলে থাকো। আমরা তো অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বার কাউন্সিলে প্রথম তৈরি হলো কোড অব কনডাক্ট।’’ ৬৮-৬৯ সালে আমি সেটি ড্রাফট করেছি।’ (সূত্র: সাপ্তাহিক ২০০০)

প্রথমা প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিকাশ’

রাষ্ট্রকল্পের পরিক্রমায় বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা, সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং অন্যান্য দেশের প্রচল সংবিধান থেকে উদ্ভূত অমীমাংসিত বিষয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বাহাত্তরের সংবিধান রচনা করা হয়। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান প্রণয়নের মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়, যা সংবিধানের ভিত্তি। সে সময়ের আন্তর্জাতিকতা ও দেশজ অভিজ্ঞতার এক যুগলবন্দী ছিল বাংলাদেশের সংবিধান এবং এর পুরোভাগে ছিলেন ড. কামাল হোসেন।

ড. রিদওয়ানুল হক ড. কামালের সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রথমা প্রকাশনা থেকে  সদ্য প্রকাশিত ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বিকাশ বইতে লিখেছেন, ‘...ড. কামাল হোসেন সংবিধানকে দেখেছেন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে যা জীবন অভিজ্ঞতা ও সমাজের চাহিদার সঙ্গে বিবর্তিত হয়।’

ড. কামাল হোসেন চিন্তা ও কর্মের বেশির ভাগ জুড়েই অনিবার্য রেফারেন্স বঙ্গবন্ধু। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক আলাপে বঙ্গবন্ধুর উল্লেখ থাকেই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পূরণ না হওয়ার কষ্ট তাঁকে পীড়িত করে। তাঁর দুঃখ বঙ্গবন্ধু এখন কেবলমাত্র ব্যানার–পোস্টার আর কায়েমি স্বার্থান্ধদের ব্যবহারের বিষয়।

আরও পড়ুন

আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁর সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁরই আহ্বানে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। প্রথম সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলান দারুণভাবে।

একানব্বইয়ের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় গণফোরামের পত্তন। হয়তো নানামুখী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পেশাগত ব্যস্ততায় রাজনীতি তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ পায়নি। কেউ কেউ এটিকে ঐতিহাসিক ব্যর্থতা বললেও ব্যাপারটা তেমন নয়। ড. কামালের রাজনৈতিক দর্শনের যদি ব্যর্থতা থেকেও থাকে, সেটি হাল আমলের রাজনৈতিক একদেশদর্শিতার পরিণাম। হেগেলের ভাষায় ‘আনহ্যাপি কনশাসনেস’! বরং ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দিই কোথায় তাঁর ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ