‘পাওয়ার’ কিসে আটকায়

বহুকালের পুরোনো বাড়ি, পরে সেটি ডেভেলপারকে দেওয়া হয়।ফাইল ছবি

আমাদের ক্ষেত্রে ‘পাওয়ার’ আটকায় লিজের জটিলতায়। কোনো সম্পত্তির মালিক তাঁর হয়ে অন্য কাউকে সেই সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করার যে বিশেষ ক্ষমতা দেন, তাকেই ‘পাওয়ার’ দেওয়া বলে। অর্থাৎ, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তার নিযুক্তি।

সেই পাওয়ার গ্রহীতা আবার এই সম্পত্তির পাওয়ার অন্য কাউকে দিতে পারবেন না। এটিই হচ্ছে পাওয়ারের ওপরে পাওয়া হয় না—তত্ত্ব। কে বলে হয় না! দিব্যি হয়! অন্য অর্থে হয়। এক জটিলতার ‘পাওয়ার’ আটকে দেয় অন্য ‘পাওয়ার’কে।

পুরান ঢাকার পৈতৃক বসতবাড়ির একটি ফ্ল্যাটের মালিকানা সূত্রে আমার প্রবাসী বড় ভাই আমাকে তাঁর অংশের বিভিন্ন কাজ তাঁর অনুপস্থিতিতে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করছেন। ১৮৮৯ সালের বাড়ি, ১৯৫২ সালে আমাদের দাদু কিনেছেন। বাবাদের ও তাঁদের পরের প্রজন্ম মিলে আমরা বেশ কয়েকজন ওয়ারিশ। তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রবাসী। জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নেওয়া ও তৎকালীন বাজারমূল্যে কেনা।

পাওয়ারের কাজের জন্য একজন মধ্যস্থতাকারী আইনজীবীর সাহায্য নিই। প্রক্রিয়াটি চলছে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে। অর্থাৎ, বিদেশে বসে দাতা দেশে থাকা গ্রহীতাকে পাওয়ার দিচ্ছেন। দেশ থেকে দলিল তৈরি করিয়ে ভাইকে পাঠালে তাঁকে সে দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে গিয়ে তাঁদের সামনে স্বাক্ষর করতে হয়।

বহুকালের পুরোনো বাড়ি, পরে সেটি ডেভেলপারকে দেওয়া হয়। গলদঘর্ম হয়ে আমার ভাই নিজেদের মালিকানা প্রমাণিত করে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সামনে স্বাক্ষর করে স্বাক্ষরিত সেই দলিল আমাকে পাঠালে সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবাকেন্দ্রে আমার স্বামী গিয়ে জমা দেন। যাচাই-বাছাই করে তারা আমাকে যথাসময়ে ফেরত দেয়। এই পর্যন্ত কাজ দ্রুতই হয়েছে।

এই এলাকায় আমার মা-বাবার পুরোনো কর্মস্থল। এখানেই আমার বড় ভাইয়ের স্কুল। এই পথেই আমি খামাখা হেঁটে গেছি বারবার। এই পথেই বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে সৈয়দ হক—সবাই হেঁটেছেন। হেঁটেছেন অগুনতি আর্মেনীয় বণিক, ইংরেজ কোম্পানির কত বাহাদুর। মুঘলদের সময় বোধ করি এই রাস্তা হয়নি, তাই ধরে নিচ্ছি তারা হাঁটেননি।

এর পরের কাজ সেই সম্পত্তির দলিল যাচাই করে দেখা যে এর সঙ্গে সরকারের কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে কি না। এ পর্যায়ে এসে কাজটি আটকে যাওয়ায় মধ্যস্থতাকারী আইনজীবী পাল্টে আরেক আইনজীবীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নিই।

কেস যখন অপেক্ষা করতে করতে প্রায় ‘স্যুটকেস’, পাওয়ারের দলিল কার্যকর করার জন্য বরাদ্দ সময়সীমা যখন প্রায় শেষের পথে এবং উৎকণ্ঠা যখন কণ্ঠাগত, তখন আমি নিজেই ‘বলম বলম বাহু বলম’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আইনজীবী জানান, আমাকে সব মূল দলিল নিয়ে দেখাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে এই সম্পত্তির সঙ্গে সরকারের কোনো স্বার্থ জড়িয়ে নেই।

সব কাগজসহ আমি আমার নিজে থেকে সাহায্য করতে চাওয়া বড় বোনকে সঙ্গে নিয়ে অকুস্থলে পৌঁছে যাই। অজস্র অপেক্ষমাণ মানুষ, যাঁদের মধ্যে পা ভাঙা একজন ভদ্রলোকও আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমরাও অপেক্ষায় থাকি একদিন ডাক আসবে বলে।

দুপুরের খাবারের বিরতির পর ডাক পেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছে আমার মনে হয় রবি ঠাকুরের মায়ার খেলার গানের চরণ, ‘একি স্বপ্ন, একি মায়া, একি প্রমদার ছায়া! কাহারে হেরিলাম-’ তখন আমার সঙ্গে বহু মূল কাগজ থাকায় পদীপিসীর (কথাসাহিত্যিক লীলা মজুমদারের গল্পের চরিত্র)  মতো মনে সিংহের তেজ, বুকে এক শ হাতির বল। দলিল দেখে অত্যন্ত ভদ্রভাবে তিনি তাঁর সদিচ্ছার কথা জানিয়ে আমাদের বিষয়টি দেখছেন বলে আমাকে আশ্বস্তও করলেন।

সেদিনকার মতো ফিরে এসে পরদিন আবার যাই। এবারে আমি একা। বাইরে ‘হেল্পডেস্ক’ লেখা জায়গায় দাঁড়িয়ে কাগজ সাজানোর সময় সহায়তাকারী ভদ্রলোকের কাছে শুনলাম, দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যার অমায়িক লোক। সত্যিই তা-ই। প্রায় মোছা গলায় কথা বলেন, কান পেতে শুনতে হয়। আবারও কাগজ ঠেলে আমাকেসহ তাঁর ঘরে পাঠানো হলো। এদিনের অভিজ্ঞতা চমকপ্রদ। দলিল দেখে তিনি আমাকে জানান, ১৮৮৯ সালের কোনো কাগজ তাঁদের দলিল শাখায় পাওয়া না যাওয়ায় তিনি এই দলিলের সত্যতা যাচাই করতে পারেননি।

শেষে বিষয়টির কোনো সিদ্ধান্ত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আরও জানান,সরকারের রাজস্ব বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের যাচাইয়ের পর এই সম্পত্তি যদি খাসজমি হিসেবে প্রমাণিত না হয়, তবেই বিষয়টির সুরাহা হওয়া সম্ভব। দেশভাগের পূর্বকালের ঢাকার সম্পত্তির দলিল ঢাকায় কোথায় পাওয়া যাবে, তা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে বিষয়টিকে বাদানুবাদের বাইরে নিয়ে গিয়ে সময়ানুক্রমিক ধারাবাহিকতায় ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করতে থাকি।

তিনি তাঁর জায়গায় অপারগ, আমি আমার জায়গায় অটল। ৯০ বছরের জন্য দেওয়া লিজের সম্পত্তি ১৩০ বছর হয়েছে। বারবার লিজ নবায়নও করা হয়েছে। কিন্তু শুরুর দলিলের সত্যতা যাচাই করার জন্য উপযুক্ত কাগজ না থাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি অত্যন্ত চেষ্টা করেও আমাকে সাহায্য করতে পারছেন না। আমি তাঁর সদিচ্ছা ও চেষ্টায় কোনো ত্রুটি পাইনি।

বাইরে বের হয়ে চমৎকার দেশি ছোট বরই কিনতে কিনতে ভাবছিলাম যে এই সম্পত্তি আমার ভোগেও লাগবে না, যজ্ঞিতেও নয়; জুড়ে আছি কেবল স্মৃতির আঠায়, সেটুকু ছিঁড়তে চাই না বলেই এত চেষ্টা। কিন্তু এর শেষ কোথায়? বিষয়টি ঘটমান বর্তমান। জানি না শেষ আছে কি নেই। সেগুনবাগিচা ও ওয়ারীতে সব প্লট সরকারের তরফ থেকে লিজ অবমুক্তর ঘোষণা এলে তবেই আমাদের জটিলতা ঘুচবে। পাওয়ার আর আটকাবে না।

রাস্তার (জনসন রোড) এক ধারে সারিবদ্ধ রেস্তোরাঁ, আজাদ সিনেমা হাল, ফটোকপির দোকান, একটি ছবি তোলার স্টুডিও, বড় ঘড়ির গির্জা, শেষ মাথায় ভিক্টোরিয়া পার্ক। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাঝে শাঁখারীবাজারের ফাঁকটুকু বাদ দিলে একটানা শেষ মাথা পর্যন্ত—ডিসি অফিস, এসি ল্যান্ডের দপ্তর, জজকোর্ট, ট্রেজারি, ইউসুফ বেকারির আদিতম দোকান ও বিউটি লস্যিঘরসহ অজস্র দোকান।

এই এলাকায় আমার মা-বাবার পুরোনো কর্মস্থল। এখানেই আমার বড় ভাইয়ের স্কুল। এই পথেই আমি খামাখা হেঁটে গেছি বারবার। এই পথেই বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে সৈয়দ হক—সবাই হেঁটেছেন। হেঁটেছেন অগুনতি আর্মেনীয় বণিক, ইংরেজ কোম্পানির কত বাহাদুর। মুঘলদের সময় বোধ করি এই রাস্তা হয়নি, তাই ধরে নিচ্ছি তারা হাঁটেননি।

পুরান ঢাকায় এখন আর গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। শীত চেনা যায় বিউটির ধনেপাতা আলুর পুরসহ পুরি (কেবল শীতেই করা হয়) ভাজার কড়াই দেখে। আমি পথে খাওয়ার জন্য নিতে চাইলে এর বিক্রেতা মৃদু ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘রাস্তায় খাইতে খাইতে যাইবেন আপা! খারাপ দেখা যায়! বইসা খাইয়া যান, টকে চুবাইয়া খাইবেন, ভালো লাগব।’ চিরকাল রাস্তায় খেতে খেতে যাওয়া আমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো তাঁর কথা মেনে বসে টকে চুবিয়ে পুরি খেতে খেতে ভাবি, এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কেই–বা কাকে ভালো হয়ে চলার পরামর্শ দেয়! ভোগে না লাগুক, কাজ শেষ না হোক, উপভোগে যা পেয়েছি, তা-ই বিস্তর।

পুনশ্চ: বাড়ি এসে পাঠান সিনেমার গান শুনেছি।

‘হ্যায় জো সহি, উয়ো কারনা নেহি, ঘালাত হোনেকি ইয়েহি তো শুরুয়াত হ্যায় -
বেশারাম রাংগ কাহা দেখা দুনিয়া ওয়ালোনে-’

  • সামিনা সুলতানা শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, লালমাটিয়া সরকারি মহিলা কলেজ