মুসলিমদের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন ট্রাম্প?

মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ এপ্রিল ২০১৮ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে অভিবাসী ও আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর পদক্ষেপ অগণিত মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় চালানো হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্বাসিত করা হয়েছে। আরও বহু মানুষের জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে আশ্রয়ের পথ।

ট্রাম্পের কাণ্ডের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। এই লড়াইয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ আইন পরিবর্তন আনতে পারে। সেটি হলো ‘ন্যাশনাল অরিজিন-বেইজড অ্যান্টিডিস্ক্রিমিনেশন ফর নন–ইমিগ্র্যান্টস অ্যাক্ট’। আইনটি পাস করার জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেসে উপস্থাপন করেছেন প্রতিনিধি জুডি চু এবং সিনেটর ক্রিস কুনস। এই বিল পাস হলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্টের ধর্ম, জাতীয়তা বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা কমে যাবে এবং তাঁর জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।

আজ এই আইন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে কেন? কারণ, আশঙ্কা বাড়ছে যে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদের মুসলিম ও আফ্রিকান নিষেধাজ্ঞা আবার চালু করার পরিকল্পনা করছেন।

৮ বছর আগে প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। আদেশটি ছিল এই যে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করা হবে। আদেশ জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেশজুড়ে বিমানবন্দরগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। প্রধানত মুসলিম দেশগুলোর অসংখ্য যাত্রীকে আটকে রাখা হয়। কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিলেন না, কে ঢুকতে পারবেন আর কে পারবেন না।

শত শত পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে ট্রাম্প নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বাড়িয়ে তানজানিয়া, সুদান, মিয়ানমার, ইরিত্রিয়া, কিরগিজস্তান ও নাইজেরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে এই আদেশ ‘আফ্রিকান নিষেধাজ্ঞা’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর ফলে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর মানবিক বিপর্যয় থেকে পালিয়ে আসা মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ হারান।

সিয়াটলে বিক্ষোভ, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭
ছবি: এএফপি
২০১৭ সালে প্রথম মুসলিম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন। সেখান থেকেই গড়ে উঠেছিল নো মুসলিম ব্যান এভার আন্দোলন।

এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ভিসা থেকে বঞ্চিত হন। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মুসলিম শরণার্থী গ্রহণের হার ৯৪ শতাংশ কমে যায়।

ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা এখন প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়ে গেছে। পরিবারগুলো আজও বিচ্ছিন্ন। অনেকেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। যাত্রা ও ভিসার জন্য খরচ করা টাকা হারিয়েছেন। এর পাশাপাশি বেড়েছে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব এবং ইসলামবিদ্বেষ।

এ ধরনের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করতেই নো ব্যান আইন জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের মুসলিম ও আফ্রিকান নিষেধাজ্ঞার কারণে অসংখ্য পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এমনই ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি হলেন মারাল তাবরিজি।

২০১৮ সালে মারাল প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছিলেন। তখন তাঁর বাবা-মা পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করেন। ইচ্ছা, যেন তাঁরা নাতির জন্মের সময় পাশে থাকতে পারেন। কিন্তু মারালের বাবার ভিসার আবেদন প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে যায়। এদিকে তাঁরা যখন অপেক্ষা করছিলেন, সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞাকে বৈধ ঘোষণা করে। ফলাফল হলো এই যে মারালের বাবা-মা কেউই ভিসা পাননি।

গর্ভাবস্থায় ও সন্তানের জন্মের পর মারালের জন্য এটি ছিল বড় ধাক্কা। তার কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে। ফলে তাঁর পক্ষে দৈনন্দিন কাজ সামলানো খুবই কষ্টকর। পরিবারের সাহায্য ছাড়াই তাঁর একা সব সামলাতে হয়। দ্রুত কাজে ফেরার পরিকল্পনা থাকলেও শারীরিক ব্যথা এবং মানসিক কষ্টের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এতে তিনি প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন এবং এক বছরের বেশি সময় ধরে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন।

মারাল ছিলেন একটি মামলার অন্যতম আবেদনকারী। মামলায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে নিষেধাজ্ঞার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ভিসা পুনর্বিবেচনার নির্দেশ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। মুসলিম অ্যাডভোকেটস নামের সংগঠনটি এই মামলার সহ–আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত আদালত প্রায় ২৫ হাজার আবেদনকারীর জন্য ফি-মুক্ত পুনর্বিবেচনার আদেশ দেন। আদেশ এখনো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

সমস্যা এখানেই শেষ নয়, ট্রাম্প এবার আরও কঠোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা করছেন। তাঁর প্রশাসন শুধু নিষিদ্ধ দেশগুলোর নাগরিকদেরই নয়, বরং যাঁরা বৈধভাবেও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, তাঁদেরও সন্দেহের চোখে দেখছে। তাঁদের ওপর নজরদারি চালানো হতে পারে। এমনকি কেবল ‘শত্রুভাবাপন্ন’ বলে মনে করলেই যে কারও হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এই কারণেই মুসলিম অ্যাডভোকেটস এবং নো মুসলিম ব্যান এভার জোট ২০১৯ সাল থেকে কংগ্রেস সদস্য জুডি চু ও সিনেটর ক্রিস কুনস উত্থাপিত নো ব্যান আইন নিয়ে লড়াই করছে। এই আইন পাস হলে, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেওয়া হবে।

এই আইন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি কোনো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চান, তবে তাঁকে অবশ্যই নির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে তা করতে হবে। কোনো সম্প্রদায়কে লক্ষ্য বানিয়ে বা সামান্য অজুহাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না। এ ছাড়া যেকোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কংগ্রেসকে অবহিত করতে হবে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে হবে।

যদি নো ব্যান আইন পাস না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্টরা নির্বিচারে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার চালিয়ে যেতে পারবেন। ধর্ম বা জাতিগত বিদ্বেষের ছদ্মাবরণে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া যাবে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছেমতো।

এমন কোনো আইন নেই বলেই ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্পও একই ধারা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্ত বন্ধ করেছেন।

এই রকম নিষ্ঠুরতা ঠেকাতে নো ব্যান আইন একটি ন্যায্য ও মানবিক বিকল্প হতে পারে। বিশ্বজুড়ে যখন মানবিক সংকট বেড়েই চলেছে। এমন এক সময়ে এমন একটি আইন মানুষের জীবনে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসবে।

২০১৭ সালে প্রথম মুসলিম নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছিলেন, প্রতিবাদ করেছিলেন। সেখান থেকেই গড়ে উঠেছিল নো মুসলিম ব্যান এভার আন্দোলন। আজকের আইনপ্রণেতাদেরও সেই সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মানবিক আশ্রয়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

নো ব্যান আইন পাস করতেই হবে।

সুমাইয়া ওহিদ সিনিয়র পলিসি কাউন্সেল, মুসলিম অ্যাডভোকেটস

আল জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ