এত খরচের নির্বাচন আমাদের কী দিচ্ছে

প্রতি পাঁচ বছর পর ভোট আসে। আমাদের লাভ না হলেও একটা বিশাল খরচ হয়ে যায়।
ফাইল ছবি

২০১৪ থেকে প্রতিবার নির্বাচন আসে আর আমরা মানুষেরা আশা করি, ২০০১ ও ২০০৮-এর মতো উৎসবমুখর পরিবেশে আবার ভোট দিতে পারব। কিন্তু সব আশা পূরণ না হওয়ার মতো এই আশাও এখন দুরাশা হয়ে যাচ্ছে। এই অধমের প্রথম ভোট ছিল ২০০৮ সালে। নিজে ঘুরে ঘুরে বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। দেখেছি, মানুষ কতটা উৎসব করে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোনো ভীতি নেই, বাসা থেকে বাধা নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্ম এই উৎসব থেকে বঞ্চিত।

ফলাফল হয়ে যাচ্ছে রাজনীতি বিমুখ। এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল?

হ্যাঁ, প্রতি পাঁচ বছর পর ভোট আসে। আমাদের লাভ না হলেও একটা বিশাল খরচ হয়ে যায়। সেই খরচের ধকল নিতে হয় বাংলাদেশের মানুষকেই। ২০২৪ সালে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আমাদের সম্ভাব্য বাজেট ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা, যা বেড়ে হতে পারে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। (আজকের পত্রিকা: ১০ অক্টোবর, ২০২৩)।

এই খাতের মধ্যে আছে নির্বাচন পরিচালনা খরচ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য। এর মধ্যে খবর দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৯৪০ কোটি টাকার ইভিএম নষ্ট হয়ে গেছে (ডেইলি স্টার: ১১ নভেম্বর, ২০২৩)। এই অপচয়ের দায় কার? কিন্তু সব খরচ তো শুধু নির্বাচন কমিশনই করে না। প্রস্তুতির জন্য অন্যদেরও আছে। ভোটের আগে ডিসি, ইউএনওদের গাড়ির জন্য অনুমোদন করা হয়েছিল ৩৮১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। যদিও এ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এখনো অনুমোদন করেনি।

এদিকে সংসদ নির্বাচনের জন্য পুলিশ ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা চেয়েছিল, যা দিয়ে কেনা হবে নতুন অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিভিন্ন নিরাপত্তা সরঞ্জাম, সফটওয়্যার, গাড়ি ও অন্যান্য অপারেশনাল খরচ। (জাগোনিউজ: ৮ মে, ২০২৩)। এর মধ্যে কত টাকা পাস হয়েছে, আলাদা করে জানা না গেলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জননিরাপত্তা বিভাগে (পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) মোট ২৫ হাজার ৬৯৬ কোটি ৭৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত অর্থবছরে যা ছিল ২২ হাজার ৫৭৭ কোটি ৫৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। (বাংলা ট্রিবিউন: ১ জুন, ২০২৩) গত বছরের তুলনায় ৩ হাজার ১১৯ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পুলিশের জন্য বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫৫ শতাংশ (যুগান্তর: ২৮ মে, ২০২৩)। এ রকম নির্বাচন উপলক্ষে অনেক মন্ত্রণালয়েরই আলাদা বরাদ্দ থাকে বা খরচ হয়।

আমরা প্রতি পাঁচ বছর পর এই নির্বাচনের জন্য বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হই। শুধু সেই নির্বাচনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, যা পরিচালিত হয়েছে নিরপেক্ষ সরকার দ্বারা। আমাদের এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আর তা আমাদের ভোটের অধিকার স্থাপনের মাধ্যমেই। আমাদের সংসদ অকার্যকর হওয়ার একটা বড় কারণ সংবিধানের ৭০ ধারা, যা সংশোধন না করলে সংসদ কখনোই কার্যকর হবে না।

এ তো গেল সরকারি খরচের হিসাব। ২০১৮ সালে টিআইবির ১০৪ জন প্রার্থীর মধ্যে এক সমীক্ষাতে একেকজন প্রার্থী গড়ে ৭৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৮ টাকা ব্যয় করেছেন। সারা দেশে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৮৪৮ জন। গড়ে এই খরচ হলে নির্বাচনের প্রার্থীরা ভোটের জন্য খরচ করেন প্রায় ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। গত নির্বাচনে দেশে ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন, এবার মোট ভোটারের সংখ্যা এখন ১১ কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৩। (একটা সম্পূরক প্রশ্ন, ভোটার প্রায় ১২ কোটি হলে দেশের জনসংখ্যা কীভাবে ১৭ কোটির কম হয়?)

যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে ভোটারপ্রতি ১০ টাকা খরচের বিধান আছে, তা কেউ কখনো মানেন না। অতিরিক্ত খরচ যাতে না হয়, দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, যা তারা ঠিকমতো পালন করে কি না, প্রশ্ন আছে। যেহেতু এবার ভোটার সংখ্যা ও জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এবার খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা।

আরও পড়ুন

এবার আসি সহিংসতা প্রসঙ্গে। ২০১৩ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত সহিংসতাতে মারা গিয়েছিলেন ১৪২ জন (উইকিপিডিয়া), ২০১৮ সালে মারা গেছেন ২২ জন (ডয়চে ভেলে: ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮)। এতগুলো অমূল্য প্রাণ যে ঝরে গেল, কোনো হত্যার বিচার হয়নি।

এর দায় কার? ২০১৩ সালের অবরোধ-হরতালের সময় ডিসিসিআই হিসাব করে দেখিয়েছিল, হরতালের জন্য দৈনিক ক্ষতি হয় ২০ কোটি মার্কিন ডলার। এই হরতাল-অবরোধ দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে দুই প্রধান দলই—যখনই তারা বিরোধী দলে থাকে। এখন আবার হরতাল-অবরোধ ফিরে এসেছে। আর এর জন্য যে প্রাণহানি বা আর্থিক যে ক্ষতি হবে, তা হবে এই দেশেরই।

এ তো গেল দেশের নির্বাচন বা নির্বাচন বাধা দেওয়ার ফলাফলে আর্থিক এবং প্রাণহানির কথা। এখন দেখি এই ভোটের ফলাফলে পাওয়া সংসদে আমাদের জন্য কতটা কাজে আসে?

টিআইবি এক জরিপে দেখিয়েছে, জানুয়ারি ২০১৯-এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ব্যয়িত সময় প্রায় ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ।  ২০১৯-২০-এ যুক্তরাজ্যে এই হার ছিল প্রায় ৪৯ দশমিক ৩ এবং ২০১৮-১৯-এ ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ দশমিক শূন্য শতাংশ। একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় ৬১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৪ টাকা।

আর সংসদ সদস্যরা নির্ধারিত সময়ে না আসায় সংসদের ২২টি অধিবেশনে কোরাম-সংকটের কারণে সংসদ কার্যক্রম শুরু হতে দেরি হওয়ায় সংসদের ব্যয় হয়েছে ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। এর অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ আট হাজার ৭৭৯ টাকা। আইন প্রণয়ন, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চলতি সংসদের অধিবেশনগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।

একই সঙ্গে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনায় স্পিকারের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি ছিল। সংসদীয় কার্যক্রমে সদস্যদের অনুপস্থিতি, যথাযথ গুরুত্বসহকারে অংশগ্রহণ না করা, প্রতিপক্ষের মতামত প্রকাশে বিঘ্ন ঘটানো ও মতামত গ্রহণ না করার কারণে কার্যক্রমগুলোর কার্যকারিতা কমেছে। চলতি সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় সরকারদলীয় সদস্যরা তাঁদের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সরকারের প্রশংসায় ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ সময় ব্যয় করেছেন।

তবে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের সদস্যরাও সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় সময় ব্যয় করেছেন। এই সংসদে পাসকৃত ৫২ শতাংশ বিলের ক্ষেত্রে কোনো সংশোধনী গৃহীত হয়নি এবং ৪৭ শতাংশ বিলে আংশিকভাবে সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। বিলের ওপর প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাব থাকলেও সংশোধনী গ্রহণের ক্ষেত্রে শব্দ সন্নিবেশ ও প্রতিস্থাপনই প্রাধান্য পেয়েছে (কালের কণ্ঠ)।

আরও পড়ুন

২০১৩-এর আগেও বিরোধী দলের ওয়াক আউটের কারণে কার্যকর সংসদ আমরা কখনোই পাইনি। আমাদের আয়করের টাকা যে নষ্ট হচ্ছে, তা এখানেও দেখার কেউ নেই।

আমরা প্রতি পাঁচ বছর পর এই নির্বাচনের জন্য বিশাল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হই। শুধু সেই নির্বাচনই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে, যা পরিচালিত হয়েছে নিরপেক্ষ সরকার দ্বারা। আমাদের এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আর তা আমাদের ভোটের অধিকার স্থাপনের মাধ্যমেই। আমাদের সংসদ অকার্যকর হওয়ার একটা বড় কারণ সংবিধানের ৭০ ধারা, যা সংশোধন না করলে সংসদ কখনোই কার্যকর হবে না।

এ ছাড়া আনুপাতিক সরকারব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্যকরণ, প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থাসহ অনেক কিছু এখন সুশাসনের জন্য প্রয়োজন। দেশের মানুষ গণতন্ত্র বলতে শুধু ভোটের অধিকার বোঝে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিধি অনেক ব্যাপক। ২০১৪ থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক সব সূচকই নিম্নগামী। আমাদের সবার জন্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, আর যার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই।

  • সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
    ই-মেইল: [email protected]