নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা আর নম্বরের ব্যাপারটি এখন কেমন

আমাদের স্কুলগুলোতে নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীর ক্রম বা রোল নির্ধারণ করা হয়। অথচ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা দরকার ছিল শিক্ষার্থী যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করল।ফাইল ছবি

কোনো কোনো অভিভাবক মনে করছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা নেই। তাই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা হচ্ছে না। তাঁরা আরও মনে করছেন, এই শিক্ষাক্রমে ‘মূল্যায়ন’ নামে যা আছে, তাতে কোনো নম্বর নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ ধরনের ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও নম্বরের ব্যাপারটি স্পষ্ট করা দরকার।

প্রথমে বোঝা দরকার পরীক্ষা কেন নেওয়া হয়। পরীক্ষা নেওয়া হয় শিক্ষার্থীর শিখন অবস্থা যাচাই করার জন্য। অর্থাৎ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয় একজন শিক্ষার্থী কোনো একটি দক্ষতার কতটুকু অর্জন করল। শিক্ষাক্রমে এ ধরনের দক্ষতাকে বলে ‘যোগ্যতা’। প্রতিটি শ্রেণির একেকটি বিষয়ের জন্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে।

পরীক্ষায় কোনো বিষয়ে এ প্লাস পেলেই বলা যাবে না শিক্ষার্থী ওই বিষয়ে যোগ্যতার সব কটি পুরোপুরি অর্জন করেছে। যোগ্যতায় নির্ধারিত দক্ষতাটুকু যদি বাস্তব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী প্রয়োগ করতে না পারে, তবে বলতে হবে সেই যোগ্যতা অর্জিত হয়নি।

বিদ্যালয়ের পরীক্ষার সঙ্গে তাই নম্বর বা জিপিএর সম্পর্কটি জোরালো নয়। আমাদের স্কুলগুলোতে নম্বর দিয়ে শিক্ষার্থীর ক্রম বা রোল নির্ধারণ করা হয়। অথচ পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা দরকার ছিল শিক্ষার্থী যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করল। এভাবে শিক্ষার্থীর শিখন-ঘাটতি বা শিখন-দুর্বলতাও শনাক্ত করা যেত। একই সঙ্গে এই ঘাটতি বা দুর্বলতা দূর করে তাকে অধিকতর দক্ষ করে তোলা সম্ভব ছিল।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি যোগ্যতাকে আবার এক বা একাধিক পারদর্শিতার সূচকে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সূচক আবার তিনটি স্তরে বিভক্ত। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতার স্তর বা অবস্থান যাচাই করা সম্ভব। নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বোঝা যাবে যোগ্যতার কতটুকু অর্জিত হয়েছে, কতটুকু বাকি আছে।

শিক্ষার্থীর অবস্থানের ভিত্তিতে তার দুর্বলতাও শনাক্ত করা যাবে। এর মাধ্যমে শিক্ষক সেই দুর্বলতা দূর করার উদ্যোগ নেবেন। আগে শিক্ষার্থীরা যেখানে নম্বরের জন্য প্রতিযোগিতা করত, এখন সেখানে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে দক্ষতা অর্জনের জন্য।

নতুন শিক্ষাক্রমে যেসব বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি আত্মস্থ করতে শিক্ষকদেরও খানিক সময় লাগবে। অ্যাপসের মাধ্যমে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, তাঁরা ধীরে ধীরে সেটি বুঝে উঠছেন। আশা করা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জনকে নিশ্চিত করবে। বাজারের গাইডবই এ ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা করতে পারবে না। এমনকি প্রাইভেট পড়ে বা কোচিং করেও যোগ্যতা নিশ্চিত করার সুযোগ নেই।

এই দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটি আকস্মিকভাবে ঘটে না, ধীরে ধীরে ঘটে। তাই নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নিয়মিত কাজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষক যাচাই করবেন শিক্ষার্থীর অবস্থান কোথায়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দুর্বল বিষয়গুলো দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন এবং প্রয়োজনে ‘শিখন অভিজ্ঞতা’ পুনরায় নতুন করে পরিচালনা করবেন।

ধারাবাহিক মূল্যায়নের বাইরে বছরে দুটি সামষ্টিক মূল্যায়নও রাখা হয়েছে। সে দুটি মূল্যায়নেরও উদ্দেশ্য নম্বর দেওয়া নয়, বরং শিক্ষার্থীর অবস্থা যাচাই করা। সামষ্টিক মূল্যায়নেও একেকটি যোগ্যতার বিপরীতে এক বা একাধিক পারদর্শিতার সূচক নির্ধারণ করা আছে।

প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীকে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যোগ্যতা অর্জন করাই যেহেতু মূল লক্ষ্য, তাই স্কুলজীবন শেষে যে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেখানেও নম্বরের ব্যাপারটিকে গৌণ করার চিন্তা চলছে। অনেকে বলতে পারেন, তাহলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কাজটি কীভাবে সম্পন্ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের পরীক্ষার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষার বা চাকরির পরীক্ষার পার্থক্য বোঝা দরকার।

ভর্তি পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষা আসলে ক্রম নির্ধারণের পরীক্ষা। সেখানে পরীক্ষা নেওয়ার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকবেন, তাঁরাই ঠিক করবেন কোন প্রশ্নে কীভাবে শিক্ষার্থীকে যাচাই করা হবে। তবে এ ধরনের পরীক্ষায় এমন প্রশ্ন রাখতে হবে, যা পূর্বে অর্জিত যোগ্যতার সঙ্গে সমন্বিত হয়। স্কুলজীবনের একটি যোগ্যতা যদি হয় ‘সাঁতার কাটতে পারা’, তবে ভর্তি পরীক্ষা বা চাকরির পরীক্ষার জন্য সেটি হবে—কার আগে কে সাঁতরে যেতে পারে।

নতুন শিক্ষক্রমকে বলা হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক’। শিক্ষার্থীর বর্তমান অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে তাকে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর যোগ্যতার জন্য উপযোগী করে তোলাই এই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। একই সঙ্গে অর্জিত যোগ্যতাকে সে যেন তার বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারে, সে জন্য এই শিক্ষাক্রমে প্রায়োগিক কাজ রয়েছে।

অনেক অভিভাবক নতুন শিক্ষাক্রমের মূলনীতি বুঝতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণকে প্রশংসা করছেন। এখন শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো লিখছে, পরস্পর আলোচনা করছে, নতুন কিছু বানাচ্ছে, হাতে–কলমে পরীক্ষা করছে। অভিভাবকেরা দেখতে পাচ্ছেন, যে শিক্ষার্থী আগে পড়া মুখস্থ করত, সে এখন বুঝে বুঝে পড়ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের শিখন-শেখানো পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষক শুরুতেই আলোচনা করেন না। তিনি আগে শিক্ষার্থীদের আলোচনার সুযোগ দেন এবং তাদের অবস্থা বুঝে নেন। এরপর তিনি আলোচনা করেন এবং তাদের নতুন কাজ দিয়ে যাচাই করেন। আগে যেমন কেবল লিখিত মূল্যায়ন ছিল, এখন সেখানে মুখে বলা ও করে দেখানোর মতো কাজও রাখা হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার পাশাপাশি দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে মূল্যায়নে আনা হয়েছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে কিছু অভিনব ধারণা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যেমন শিক্ষার্থীর বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতাকে বিবেচনায় নিয়ে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন-কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। একেকটি নির্ধারিত যোগ্যতার পেছনে কয়েকটি করে শিখন-অভিজ্ঞতা বা শ্রেণি-কার্যক্রম রাখা হয়েছে।

এসব শিখন-অভিজ্ঞতা আবার অনেকগুলো সেশনে বিভক্ত। কয়েকটি সেশনের পরপরই পারদর্শিতার সূচক দিয়ে যাচাই করা হবে ওই শিক্ষার্থীর শিখন অবস্থা কোন স্তরে আছে। আর মূল্যায়নপত্রে বা রেজাল্ট কার্ডে শিক্ষার্থীর দুর্বলতা কোথায়, সক্ষমতা কোথায় তার বিবরণ লেখা থাকবে। যেমন কোনো শিক্ষার্থী বাংলা বিষয়ের ব্যাকরণে ভালো, না সৃজনশীল রচনায় ভালো তা মূল্যায়নপত্রে লেখা থাকবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে যেসব বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলো পুরোপুরি আত্মস্থ করতে শিক্ষকদেরও খানিক সময় লাগবে। অ্যাপসের মাধ্যমে কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, তাঁরা ধীরে ধীরে সেটি বুঝে উঠছেন। আশা করা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষার্থীর যোগ্যতা অর্জনকে নিশ্চিত করবে। বাজারের গাইডবই এ ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা করতে পারবে না। এমনকি প্রাইভেট পড়ে বা কোচিং করেও যোগ্যতা নিশ্চিত করার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় এই শিক্ষাক্রম চালু করা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে, এই প্রশ্ন তোলেন অনেকে। তাঁদের জানা থাকা দরকার, যেকোনো শিক্ষাক্রমের তিনটি পর্যায় আছে: ১. প্রণীত শিক্ষাক্রম, ২. বাস্তবায়িত শিক্ষাক্রম এবং ৩. অর্জিত শিক্ষাক্রম। প্রণীত শিক্ষাক্রমে যতটুকু প্রত্যাশা করা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে তার সবটুকু কাজে লাগানো যায় না। আর প্রত্যাশিত শিক্ষাক্রম থেকে শেষ পর্যন্ত অর্জিত শিক্ষাক্রমের ঘাটতি কিছু রয়েই যায়। এই ঘাটতি যত কমানো যায়, শিক্ষার লক্ষ্য তত বেশি পূরণ করা সম্ভব হয়।  

  • তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।