সাংবাদিক রব্বানি হত্যা: খুনিদের দুঃসাহস ও পুলিশ সুপারের সাফাই

সাংবাদিক গোলাম রব্বানি
ছবি : সংগৃহীত

মাহমুদুল আলম ওরফে বাবুর সাহসের তারিফ করতে হয়। তিনি জামালপুরের বকশীগঞ্জের একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। এ ধরনের নেতা ও জনপ্রতিনিধি দেশে অনেক আছেন। অনেকের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বও হয়তো আছে। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বের কারণে নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পেটোয়া বাহিনী দিয়ে একজন পেশাদার সাংবাদিককে হত্যা করানোর মতো বুকের পাটা সবার থাকে না। মাহমুদুল আলম সেটা দেখিয়েছেন।

কীভাবে মাহমুদুল আলম এই দুঃসাহস দেখালেন। প্রথমত, তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা। দ্বিতীয়ত, তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। তৃতীয়ত, যেই সাংবাদিককে পেটোয়া বাহিনী দিয়ে খুন করিয়েছেন, সেই সাংবাদিকের হাতে কলম থাকলেও তাঁর মতো কোনো পেটোয়া বাহিনী নেই। কথায় বলে অসির চেয়ে মসির ক্ষমতা বেশি। কিন্তু মাহমুদুল আলমেরা যুগে যুগে প্রমাণ করেছেন অসিই ক্ষমতার উৎস।

নিজের বাহিনী দিয়ে গোলাম রব্বানিকে খুন করানোর আগে মাহমুদুল আলম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁকে ঘায়েল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সফর হননি।

বাংলাদেশে এখন সাংবাদিকদের কাছে বড় আতঙ্কের নাম হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ। এই আইনে কোনো সাংবাদিকের নামে মামলা দিলেই তাঁকে চৌদ্দশিকের ভেতরে ঢুকতে হয়। এরপর কারাগারে থেকে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি নির্দোষ। সেটি সবার পক্ষ সম্ভব হয় না। আবার সৌভাগ্য ক্রমে কেউ কেউ জামিন পেয়ে যান। কিন্তু সাংবাদিক শিকারের এই মোক্ষম আইনে ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে ফাঁসাতে পারেননি। বোঝা যায়, তিনি যে অভিযোগে মামলা করেছিলেন তার যথাযথ কোনো ভিত্তি ছিল না।

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক সমাজ গোলাম রব্বানির হত্যা বিচার ও ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। ঢাকায়ও সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিবাদ করেছে। জামালপুরের সাংবাদিকেরা জেলা পুলিশ সুপার নাসিরউদ্দিন আহমদের অপসারণ চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, খুনিচক্র নাকি গোলাম রব্বানিকে হত্যার করার জন্য রব্বানিকে মারধর করেননি। ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য মারধর করেছেন। তাহলে কি খুনিরা রব্বানিকে হত্যার আগে পুলিশ সুপারের সঙ্গে পরামর্শ করে গিয়েছিল? একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে খুনিদের পক্ষে সাফাই গাইতে আবোলতাবোল কথা বলতে পারেন?

আইনি পথে সুবিধা করতে না পেরে মাহমুদুল আলম বেআইনি পথ ধরলেন। তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে গোলাম রব্বানিকে মারধর করার বিষয়টি তদারক করেছেন। এটি কী করে সম্ভব হলো? মানুষ যখন মনে করে খুন করলেও কিছু হবে না। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারবেন, তখনই এই ধরনের কাজ করতে পারেন। এদের কাছে ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। গোলাম রব্বানি হত্যার বিচার হলেও তার মায়ের কান্না মুছবে না। স্ত্রী ও সন্তানদের শূন্যতা পূরণ হবে না। এ আমরা কেমন সমাজে বাস করি। একজন পেশাগত সাংবাদিক বাড়ি ফেরার পথে খুন হয়ে যাবেন!

জামালপুরের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহমুদুল আলম এক সময় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। একসময় গ্রামে মুদি দোকান চালাতেন। তাঁর চাচাতো ভাই ছিলেন পুলিশের বড় কর্তা। অনেকেই মনে করেন সেই সূত্রে অল্প সময়ে তিনি একাধিক বাড়ি ও সম্পত্তির মালিক হন।

মাহমুদুল আলম ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজ করেন। পরে যোগ দেন বিএনপিতে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন বাবু। আওয়ামী লীগে ভিড়েই সাধুরপাড়া ইউপি নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে ফেল করার পর ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৬ ও ২০২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
মাহমুদুল আলমের সঙ্গে সাংবাদিক গোলাম রব্বানির কোনো বিরোধ ছিল না। তারপরও কেন তাকে হত্যা করলেন?

কারণ মাহমুদুল আলম তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে সংক্রান্ত একটি খবর তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। এই খবর আরও অনেক পত্রিকা ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে ইউপি চেয়ারম্যান ও তার লোকজন গোলাম রব্বানিকে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। তিনি সত্য খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকেননি। এটাই তাঁর অপরাধ।

গোলাম রব্বানির বন্ধু আল মুজাহিদ। তারা দুজন গত বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে বকশীগঞ্জ উপজেলার পাটহাটি মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আলাদা বাইকে ছিলেন। আল মুজাহিদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, সন্ত্রাসীরা প্রথমে ব্যস্ততম এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে টেনেহিঁচড়ে সাংবাদিক গোলাম রব্বানিকে নামায়। তাঁকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি দিতে দিতে অন্ধকার টিঅ্যান্ডটি সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল আরও ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী।

সবাই মিলে যে যেভাবে পারছিল, রব্বানিকে পেটাচ্ছিল। আর দূর থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মূল অভিযুক্ত সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মাহমুদুল আলম। একপর্যায়ে কেউ একজন লাথি মেরে পাশে থাকা একটি দেয়ালের ইট ভাঙে।চেয়ারম্যানের ছেলে সেই ইট হাতে নিয়ে রব্বানিকে আঘাত করেন। সাংবাদিক গোলাম রব্বানি বারবার বাঁচার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন। তবু তাঁকে নির্মমভাবে মারছিল তারা। একপর্যায়ে মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে সবাই চলে যায়।

জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তিনি পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন।
ছবি : প্রথম আলো

এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, জামালপুরের সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে তিনি পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন। হত্যাকাণ্ড শেষে তিনি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে তাঁকে ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব।

‘ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকেই চেয়ারম্যান ওই হামলা চালিয়েছেন’ উল্লেখ করে খন্দকার আল মঈন বলেন, জামালপুরের সাধুরপাড়া ইউপির চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর ক্ষুব্ধ হন। তিনি গোলাম রব্বানির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। বুধবার আদালত মামলাটি খারিজ করেন। এরপর রাব্বানি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এতে আরও খেপে যান ওই চেয়ারম্যান। পরে পরিকল্পিতভাবে নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে রব্বানির ওপর হামলা চালান।

আরও পড়ুন

সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ঘাতকেরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কয়েকজনকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পাবে কি? আমাদের দেশে ক্ষমতার প্রভাব খাঁটিয়ে অনেক সময়ই বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। গোলাম রব্বানি ছিলেন একজন পেশাদার সাংবাদিক। তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা তাঁর আয়ের ওপরই নির্ভরশীল ছিলেন। এখন তাঁরা নিরুপায়।

সাংবাদিক নিগ্রহ ও হত্যার ঘটনায় প্রভাবশালীরা নানা রকম গল্প সাজান। বলেন, সাংবাদিকতার কারণে তিনি খুন বা নির্যাতনের শিকার হননি। কিন্তু এখানে ঘটনাটি এতই লোমহর্ষক যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার সুযোগ নেই। মাহমুদুল আলম নিজের বাহিনী দিয়ে গোলাম রব্বানিকে খুন করিয়েছেন; যার অন্যতম সদস্য ছিলেন, তার পুত্রও। পিতা খুনের নির্দেশ দিয়েছেন, পুত্র ও তার সঙ্গীরা তামিল করেছেন।

বাংলাদেশে আর কত সংবাদিক খুন ও নির্যাতনের শিকার হবেন? প্রভাবশালীরা আর কত আস্ফালন দেখাবেন? আর কত মানুষের প্রাণ নেবেন?

চলতি বছর গোলাম রব্বানিই প্রথম সাংবাদিক যিনি প্রভাবশালী মহলের জিঘাংসার শিকার হয়ে জীবন দিলেন। কিন্তু এই কয়েক মাসে সাংবাদিক নির্যাতনের আরও বহু ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যে ৫৬ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, মামলা, হুমকির শিকার ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। আসকের প্রতিবেদনে প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে ভোররাতে তুলে নিয়ে যাওয়া ও পরে ডিএসএ আইনে মামলা দেওয়ার বিষয়টিও উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন

অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে, মাহমুদুল আলমের বেলায়ও তাই ঘটেছে। হত্যার মামলা ও গ্রেপ্তারের পর আওয়ামী লীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কারের ঘোষণা এল। মাহমুদুল আলম যে এত খারাপ লোক সেটি তারা জানতেন না। এটা দায় অস্বীকারের অপকৌশল। জাতীয় পার্টি ও বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগে এ রকম আর কত মাহমুদুল আলম ‘অনুপ্রবেশ’ করে দেশ ও জনগণের সর্বনাশ করেছেন, তার হিসেব কে রাখে?

দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক সমাজ গোলাম রব্বানির হত্যা বিচার ও ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। ঢাকায়ও সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিবাদ করেছে। জামালপুরের সাংবাদিকেরা জেলা পুলিশ সুপার নাসিরউদ্দিন আহমদের অপসারণ চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, খুনিচক্র নাকি গোলাম রব্বানিকে হত্যার করার জন্য রব্বানিকে মারধর করেননি। ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য মারধর করেছেন। তাহলে কি খুনিরা রব্বানিকে হত্যার আগে পুলিশ সুপারের সঙ্গে পরামর্শ করে গিয়েছিল? একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে খুনিদের পক্ষে সাফাই গাইতে আবোলতাবোল কথা বলতে পারেন?

অতীতে বহু সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুন হলেও বিচার হয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই। ক্ষমতার দম্ভ ও বিচারহীনতাই সাংবাদিকদের জীবন ও পেশাকে ক্রমাগত ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি। ইমেইল: [email protected]