মহররম ও আশুরার তাৎপর্য এবং কারবালার শিক্ষা

ইতিহাসের স্তরে স্তরে, পৃথিবীর নানা পরিবর্তনের ধাপে ধাপে, মানবসভ্যতায় আশুরার প্রভাব ও সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান। আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, পৃথিবীতে তাঁর আগমনসহ অসংখ্য নবী–রাসুলের জীবনের বাঁকে বাঁকে আশুরার স্মৃতি অম্লান।

মহররম ও আশুরার শিক্ষা ও তাৎপর্যকে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত চিরভাস্বর করে রাখবে কারবালার শহীদানের অবদান। মহররম পবিত্রতা, মর্যাদা, সম্মান ও সুনাম–সুখ্যাতির প্রতীক। আশুরা পূর্ণতা প্রাপ্তি ও সফলতার আকর; কারবালা বালামসিবত ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রেরণা।

 ‘মহররম’, ‘আশুরা’ ও ‘কারবালা’—এই শব্দগুলো যেন একটি ছাড়া অন্যগুলো পূর্ণতা পায় না। বিচ্ছিন্ন একটির প্রয়োগে ভাবেরও পূর্ণ প্রকাশ ঘটে না।

সৃজনশীলতা ও নবসৃষ্টির বার্তা নিয়ে মহররম আসে। আশুরা আসে সৃষ্টিকর্মকে পূর্ণতা দান করতে। কারবালা আসে জীবনের সার্থকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করতে। সুতরাং এই মহররম, আশুরা ও কারবালা মানবজীবনব্যাপী সর্বকালে ব্যাপৃত। সত্য–মিথ্যা, ন্যায়–অন্যায়, ভালো–মন্দ; আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত এসবের দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ফয়সালা কারবালার সংঘাত।

হজরত হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন মহররম ও আশুরার প্রকৃত তাৎপর্য। সঙ্গে পরিবারের সদস্যসহ ৭২ জন সঙ্গীর আত্মত্যাগ শিখিয়ে গেল সত্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য ও অনুরাগের পরাকাষ্ঠা। শিশু আলী আসগরের শাহাদাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহান আল্লাহর বাণী, ‘বলো, ‘‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভ্রাতা, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার মন্দা পড়ার আশঙ্কা করো আর তোমাদের বাসস্থান, যা তোমরা ভালোবাসো; তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।”

আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎ পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা-৯ তওবা, আয়াত: ২৪)। এই একটি আয়াত যেন আমাদের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করে দেয় এবং জানিয়ে দেয় মানবজীবনে লক্ষ্য অর্জনের পথের সব বাধার কথা। এরই সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ মহানবী (সা.)–এর বাণী, ‘দুনিয়ার মোহ সব পাপের মূল।’ (বুখারি) একদিকে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ভালোবাসা ও আনুগত্য। অপর দিকে দুনিয়ার মোহ; পিতা–মাতা, সন্তানসন্ততি, ভ্রাতা-ভগ্নি, পতি-পত্নী, স্বজন-গোষ্ঠী, অর্জিত-সঞ্চিত সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বাড়িঘর, স্বদেশ-বাসস্থান এসবের মায়া।

সব সময়ই সমাজে কিছু না কিছুসংখ্যক ভালো মানুষ থাকা প্রয়োজন, যাঁরা অন্যায়ের প্রতিবাদে সুদৃঢ় ও অবিচল থাকবেন, তাহলে অন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। অন্যায় তখনই প্রতিষ্ঠা পায়, যখন ভালো মানুষেরা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে মৌনতা অবলম্বন করেন। এসব মৌনব্রত পালনকারী ভালো মানুষের ব্যাপারে প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘সত্য বিষয় প্রকাশে নীরবতা পালনকারী বোবা শয়তান।’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে রয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, ‘জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (তিরমিজি)

ফোরাতের তীরে কারবালার প্রান্তরে হজরত হোসাইন (রা.)–এর আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়।

সর্বকালেই ঘুণে ধরা অবক্ষয়ে নিপতিত সমাজের উত্তরণের জন্য ভালো মানুষদের নির্লোভ, নির্মোহ, নির্ভয় ও নির্ভীক হতে হয়। বেরিয়ে আসতে হয় বোবা শয়তানের কাতার থেকে, শামিল হতে হয় হক কথার উত্তম জিহাদে। তবেই আসবে কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন।

ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে জালিমের অন্যায়, অপরাধ ও অপকর্মের দাস্তান, যেমন হয়েছিল কারবালার খলনায়কদের পরিণতি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা ক্ষতিগ্রস্ত নয়, যারা বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা-১০৩ আসর, আয়াত: ১-৩)

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    [email protected]