ওসমান হাদির মৃত্যুর আগেই তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের কিছু অ্যাকটিভিস্টকে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বোধ করি, এমন আরও বেশ কিছু আওয়ামী লীগ সমর্থক আছেন, যাঁরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস না দিলেও হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া এবং মৃত্যুতে সুখী বোধ করেছেন। এর বাইরে যা ঘটল, সেটা ছিল অভূতপূর্ব। সাম্প্রতিক অতীতে এমনটা কি দেখা গেছে, কোনো একজন মানুষের মৃত্যুতে পুরো জাতি ভেঙে পড়েছে? প্রার্থনা করছে? কেন হলো এমনটা?
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে যাঁরা তাঁকে চিনতেন না, তাঁরাও রাজপথে দেওয়া হাদির বক্তৃতা, মূলধারার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদির কথা শুনে জেনেছেন তাঁকে। ওসমান হাদির চিন্তা-দর্শনের সঙ্গে দ্বিমত হয়েছেন নিশ্চয়ই অনেকে। দ্বিমত হয়েছেন তাঁর প্রকাশের ভাষা এবং ভঙ্গি নিয়ে। কিন্তু দ্বিমত হওয়া মানুষেরাও এটা অনুভব করেছেন, হাদি জেনুইন। তিনি সৎ, সাহসী, দেশপ্রেমী। আর এমন মানুষেরা যেমন হন, ছিলেন বেশ খানিকটা অপরিণামদর্শী তো বটেই। না হলে বারবার হত্যার হুমকি পেয়ে, সেটা পাবলিকলি বলেও তিনি কেন সতর্ক না হয়ে, হুমকি পরোয়া না করে নির্বাচনী প্রচারে নেমে যেতেন?
শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতিতে তুমুল আলোচিত নতুন বন্দোবস্ত শুধু রাজনৈতিক রেটরিক না হয়ে বাস্তবে কেমন হওয়া উচিত, ওসমান হাদি সেটা নিজে করে দেখিয়েছেন। ঢাকার একটি আসনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য জনগণের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য আহ্বান করেছেন এবং সেটার হিসাব নিয়মিতভাবে সবাইকে জানিয়ে গেছেন। মুড়ি আর বাতাসা খেয়ে এবং খাইয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন।
প্রতিদিন তাঁর নির্বাচনী এলাকার কোনো মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে নিজেই মানুষের কাছে গেছেন, জনসংযোগ করেছেন। দিনের পর দিন বাড়ি যাননি, দেখতে পারেননি নিজের শিশুকন্যাকে। কাজ করার সময় একই সঙ্গে থেকেছেন, ঘুমিয়েছেন তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। অনেকটা প্রান্তিক পরিবারের একজন সন্তান রাজনীতিতে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করে গেছেন নিজের সততা, কর্মোদ্দীপনাকে সম্বল করে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া আর প্রচারণার ক্ষেত্রে এমন একটা নতুন বন্দোবস্তই হয়তো এই দেশের জনগণ দেখতে চেয়েছিল।
শেখ হাসিনার পতনের আগে ওসমান হাদিকে কবি হিসেবে চিনতেন অনেকে। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরই কিছু কবিতা আরও অনেক নতুন পাঠক পড়েন এবং দেখেন সেখানেও ছিল দুর্দান্ত দ্রোহের প্রকাশ। গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও তিনি খুব পরিচিত মুখের তালিকায় ছিলেন না। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন মূলত ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে। তখন গণ-অভ্যুত্থানের সময় তাঁর মাঠে থাকার ভিডিও যেমন আমাদের সামনে আসে, তেমনি সামনে আসে গণ-অভ্যুত্থানের পর নানা কর্মকাণ্ডে। এর মধ্যে মব তৈরির মতো কিছু ক্ষেত্রে তিনি সমালোচিতও হয়েছেন; কিন্তু দ্রুতই হাদি এই পথ থেকে সরে এসে যুক্ত হন নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে।
ওসমান হাদির নিজস্ব রাজনীতি ছিল এবং সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বয়ান। সে জন্যই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার। সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছাড়াও সেখানে হতো পাঠচক্র, যেখানে তিনি শুধু তাঁদের নিজস্ব মতাদর্শেরই নয়, সংযুক্ত করতে চেয়েছেন ভিন্নমতাদর্শের মানুষদেরও। এই লেখকের সঙ্গে হাদির রাজনৈতিক মতাদর্শের বড় ভিন্নতা থাকলেও তাঁকেও পাঠচক্র পরিচালনার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আপাতদৃষ্টে তাঁর নামে প্রথম আলো আর ডেইলি স্টার–এ হামলা হয়েছে, যা মূলত এক মারাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। এর আগে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে মব তৈরির ঘটনাকেও হাদি সমর্থন করেননি। একটি বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘প্রথম আলোর সামনে যারা দাঁড়িয়েছে, আমরা কি তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি? আমরা বলি, না। আপনি পারলে প্রথম আলোর বিকল্প আরও দশটি প্রথম আলো তৈরি করেন। তার অফিসের সামনে আপনাদের কাজ কী? আমরা তো সে কথা বলেছি।’
হাদির আত্মা নিশ্চয়ই বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম আলোর কার্যালয়ের হামলার দৃশ্য দেখে কষ্ট পাবে। কারণ, হাদি বিশ্বাসী ছিলেন, আস্থা রেখেছিলেন গণতান্ত্রিক পন্থায়, যেখানে বয়ান এবং মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই হবে বয়ান এবং মতাদর্শ দ্বারাই। হাদি এ জন্যও কষ্ট পেতেন যে তাঁর মতোই প্রথম আলো গণ-অভ্যুত্থানের সময়গুলোতে দুর্দান্ত সাহসিকতার সঙ্গে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ইন্টারনেট না থাকার দিনগুলোতে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর তীব্র চাপের সময়ে কাগজে ছাপা প্রথম আলোই দেশের জনগণকে জানিয়েছিল শেখ হাসিনার বর্বরতা সীমা ছাড়িয়েছে কতটা। এমন খবর ক্রমাগত মানুষের মধ্যে দ্রোহের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে গেছে।
ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর প্রথম আলোতেই এক কলামে লিখেছিলাম, দুই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কীভাবে তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানের ফসল নষ্ট হতে শুরু করেছিল। হাদির মৃত্যু আমাদের দেশেও একই রকম ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। আশা করি খুব দ্রুত নিজেদের নিবৃত্ত করব আমরা।
বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির স্থাপনের চূড়ান্ত রায় আসার পর ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা চেয়েছিল সারা ভারতের মুসলমানরা একটা দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়বে, যা তাদের নির্বাচনী ফলাফলে দারুণ ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কিন্তু সেই সময়ে মুসলিম নেতাদের আহ্বানে মুসলিমদের সংযম নস্যাৎ করে দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পনা। পরিকল্পিতভাবে ওসমান হাদিকে হত্যা নিশ্চয়ই বাংলাদেশকে অস্থির করার মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ।
আমাদের উচিত হবে নিজেরা শান্ত হয়ে, সংযত হয়ে এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া। হাদিকে আমরা যেভাবে চিনি, সেটার ভিত্তিতেই বলতে পারি, তার আত্মাও এটাই চাইবে নিশ্চয়ই। কারণ, আমরা দেখেছি, ৫ আগস্ট–পরবর্তী কিছুদিন তিনি যা–ই করুন না কেন, শেষ পর্যন্ত তিনি অনুধাবন করেছিলেন এবং নির্বাচনী যাত্রায় শামিল হয়ে প্রমাণ করেছিলেন, একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য একটি অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই প্রধান বিষয়।
● জাহেদ উর রহমান শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
