২০২৫ সালের শেষ মাসটি ছিল বেশ হতাশাজনক। নির্বিচার গুলি, নানা সংকট আর তীব্র মেরুকরণের খবরের শিরোনামে সংবাদমাধ্যম ভরা ছিল। তবু এ অন্ধকার সময়ের মধ্যেও একটি ইতিবাচক পরিবর্তন ভবিষ্যতের জন্য আশার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উন্নয়নশীল বিশ্বের নানা দেশে তরুণ প্রজন্ম এখন জোরালোভাবে চাকরি, সাশ্রয়ী খাদ্য ও জ্বালানি, অর্থনৈতিক সুযোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপের দাবি তুলছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে লাতিন আমেরিকা পর্যন্ত তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে পরিষ্কার একটি বার্তা দিচ্ছে, ‘শুনুন ও ব্যবস্থা নিন, নইলে সরে দাঁড়ান।’
নেপাল এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ। গত সেপ্টেম্বরে দেশটির সরকার ২৬টি বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করে। এসব প্ল্যাটফর্মে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে তথ্য প্রকাশ পাচ্ছিল। ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও তরুণদের জন্য সুযোগের অভাব নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ৭৩ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পরিস্থিতি সামলানোর বদলে রাস্তায় নামা হাজারো কিশোর-তরুণকে নিয়ে বিদ্রূপ করেন। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হলে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে আগুন দেন এবং ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনে হামলা চালান। পরদিনই তিনি পদত্যাগ করেন।
অনেকে মনে করেন, এ আন্দোলনের ঢেউ শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায়। সে সময় দেশটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে। জ্বালানি ও বিদ্যুতের তীব্র সংকটে তরুণদের নেতৃত্বে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে। তাঁরা তৎকালীন ৭২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের কার্যালয়ের সামনে ক্যাম্প স্থাপন করেন। অভিযোগ ছিল, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা তাঁর পরিবার দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে জড়িত। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে পড়লে গোতাবায়াকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।
এর দুই বছর পর বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। সরকার তখন টেলিযোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এবং কঠোর পুলিশি দমন চালায়। এতে শত শত সাধারণ মানুষ নিহত হন। কিন্তু এ সহিংসতা আন্দোলন দমন করতে পারেনি; বরং আরও হাজার হাজার মানুষ এতে যুক্ত হন। ঢাকায় বিক্ষোভকারীরা দ্রুত তৎকালীন ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় ও বাসভবনের দিকে মিছিল বের করেন। এর পরপরই তিনি ভারতে পালিয়ে যান।
প্রায় একই সময়ে কেনিয়ায় প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর প্রস্তাবিত কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জেন–জির নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন, শতাধিক আহত হন এবং অনেককে বিনা কারণে আটক করা হয়। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনে ঢুকে আগুন দিলে রুটো কর বৃদ্ধি প্রত্যাহার করেন এবং তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যকে বরখাস্ত করেন। চলতি বছরের জুনে আবারও বিক্ষোভ শুরু হয়, যা জনরোষের গভীরতা স্পষ্ট করে।
এদিকে পেরুতে পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে ওঠে। মানুষ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। দমন-পীড়ন পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ঘুষ কেলেঙ্কারিতে তদন্তাধীন প্রেসিডেন্ট দিনা বলুয়ার্তেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
দেশে দেশে দেখা গেছে, জেন–জির নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনগুলো খুব দ্রুত সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তথ্য ছড়িয়েছেন, সংগঠন গড়েছেন এবং নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। সরকার যখন এসব মাধ্যম বন্ধ করেছে, তখন তাঁরা এনক্রিপটেড সার্ভার, এমনকি অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্মেও সংগঠিত হয়েছেন। আর রাষ্ট্রীয় সহিংসতার মুখে তাঁরা পিছু হটেননি; বরং আন্দোলন আরও জোরালো করেছেন।
এ আন্দোলন শুধু একটি প্রজন্ম বা একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। ধনী ও দরিদ্র—সব দেশের শ্রমজীবী মানুষের অভিন্ন উদ্বেগই এতে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট, কোভিড-১৯, ইউক্রেন যুদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান অভিবাসন চাপ—এসব মিলিয়ে মজুরি, চাকরির নিরাপত্তা ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো ক্রমেই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে। তবে জেন–জি আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চান না। তাঁরা চান এমন সরকার, যারা চাকরি দেবে, দুর্নীতি দমন করবে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বিনিয়োগ করবে। এসব দাবি বাস্তবসম্মত এবং এগুলো পূরণের পথও আছে।
যুব বেকারত্ব তার একটি উদাহরণ। এক দশক আগে পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস ও স্পেন—এই ‘পিআইআইজিএস’ দেশগুলো তীব্র ঋণসংকটে ভুগছিল। এখন তাদের চারটি দেশ যুব বেকারত্ব নাটকীয়ভাবে কমিয়েছে। পর্তুগালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের বেকারত্ব ২০১৪ সালের ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবরে নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশে। আয়ারল্যান্ডে তা ২৪ দশমিক ২ থেকে কমে হয়েছে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। গ্রিসে ৫২ দশমিক ৮ থেকে ২০২৪ সালে নেমেছে ২২ দশমিক ৪ শতাংশে। স্পেনে একই সময়ে হার কমেছে ৫৩ দশমিক ২ থেকে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশে।
এ অগ্রগতির পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ইয়ুথ গ্যারান্টি’ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির আওতায় সরকারগুলো প্রতিশ্রুতি দেয়—স্কুল শেষ করার বা বেকার হওয়ার চার মাসের মধ্যে তরুণদের চাকরি, প্রশিক্ষণ, শিক্ষানবিশ সুযোগ বা পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হবে। সব সমস্যা মেটেনি, কিন্তু এটি দেখিয়েছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কী করা সম্ভব। দুর্নীতি দমন অবশ্য আরও কঠিন। আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, মলদোভা ও ইউক্রেনের অভিজ্ঞতা তা প্রমাণ করে। তবু অগ্রগতি সম্ভব। এ জন্য দরকার দক্ষ ও ভালো বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারী, শক্তিশালী নজরদারি ও অডিট ব্যবস্থা এবং প্রকৃত রাজনৈতিক জবাবদিহি। ই-গভর্ন্যান্সও সহায়ক হতে পারে। রুয়ান্ডার ডিজিটাল সরকারি ক্রয়ব্যবস্থা দুর্নীতির সুযোগ কমিয়েছে। জর্জিয়ায় পুরোপুরি ইলেকট্রনিক টেন্ডার ব্যবস্থা চালুর ফলে প্রথম দিকে পরিমাপযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে।
স্বচ্ছতা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি যখন সহনীয় হয়ে ওঠে, তখন তা ছড়িয়ে পড়ে। আর যখন তা প্রকাশ পায়, তখন সামাজিক চাপ ও সুনামের ঝুঁকি দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করে। তাই হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা, সহজলভ্য দুর্নীতিবিরোধী তথ্যভান্ডার ও ব্যবসায়িক খাতের দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য।
নাইরি উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ