তাইওয়ান নিয়ে চীনকে বাগে রাখতে কতটা সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র

তাইওয়ান দখলে নিতে এখনই মোক্ষম সময় মনে করছে চীনছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনার পারদ কমাতে যতই উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা চেয়েছে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রশাসন ততই তাইওয়ানের ওপর বল প্রয়োগ করেছে।

তবে গত মাসের মতো অবস্থা এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উই ও মার্কিন জাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ব্যাংককে যখন আলোচনা করছিলেন, ঠিক সেই সময় চীন ৩৩টি যুদ্ধবিমান ও ৭টি যুদ্ধজাহাজ তাইওয়ানের দিকে পাঠিয়েছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, সি চিন পিং চীন-তাইওয়ান ‘পুনরেকত্রীকরণের’ চেষ্টা জোরদার করতে শিগগিরই আরও বড় ধরনের অভিযান চালাতে পারেন।

কিন্তু ইতিহাস বলছে, তাইওয়ান কখনোই চীনা প্রজাতন্ত্রের অংশ ছিল না। এটি ইতিহাসের সুদীর্ঘ সময় ধরে স্বশাসিত দ্বীপ হিসেবে টিকে আছে। তারপরও প্রেসিডেন্ট সি তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবি বাস্তবায়ন করতে তাঁর বলপ্রয়োগের অভিপ্রায় গোপন করেননি। 

বলা হচ্ছে সম্প্রতি সান ফ্রান্সিসকোতে সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট সি তাঁর অভিপ্রায়ের কথা আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, চীন কখন তাইওয়ানকে একীভূত করবে, শুধু সেটি নিয়েই তাইওয়ান ইস্যুতে আলোচনা হতে পারে।

তাইওয়ানকে চীনের একীভূত করার সেই সময় যে খুব কাছেই, সে কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধে বর্তমানে আমেরিকার মনোযোগ নিবদ্ধ রয়েছে এবং মার্কিন সামরিক সহায়তা সেখানে নিয়োজিত রয়েছে। একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক অদলবদলের প্রক্রিয়া এখন চলমান। সে কারণে এ সময়কেই সি তাইওয়ান দখলের মোক্ষম সময় বলে মনে করতে পারেন। এ ছাড়া তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বপন্থী দল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রার্থীকে ভোটাররা টানা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করায় চীন বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারে। 

সি ইতিমধ্যে তাইওয়ানের এয়ার ডিফেন্স জোনে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছেন এবং দ্বীপরাষ্ট্রটিকে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা শুরু করেছেন। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দুই–তৃতীয়াংশ মার্কিন বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, তাইওয়ান প্রণালি নিয়ে সংকট এ বছরই শুরু হতে যাচ্ছে।

অনেকে মনে করতে পারেন, চীনের এই ইটের জবাবে যুক্তরাষ্ট্র পাটকেল ছুড়তে পারে। তাঁরা মনে করতে পারেন, বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষার দিক থেকে শক্তিশালী করতে পারে এবং তাইওয়ানের ওপর হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্র কড়া প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে ঘোষণা দিয়ে চীনকে ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসনের দিক থেকে সে ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না।

তাইওয়ানকে যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য যে চুক্তি বলবৎ রয়েছে, তা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাইডেন ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, তিনি চীনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাতে জড়াতে চান না।

তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো গোলমেলে অবস্থায় রয়ে গেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের পক্ষে কথা বলছে, অন্যদিকে সেই সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ানো চীনের সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে। এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ না করায় সম্ভবত সি চিন পিং অধিকতর সাহসী হয়ে উঠেছেন।

চীন তার জিনজিয়ান প্রদেশে প্রায় ১০ লাখ মুসলমান নাগরিককে আটক করে রেখে নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন ছিনিয়ে নিয়েছে। এরপরও চীনকে পশ্চিমাদের দিক থেকে আসা কোনো অর্থবহ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়নি। 

গত সেপ্টেম্বরে বাইডেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, চীন যদি তাইওয়ানে আঘাত হানে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবে কি না। জবাবে তিনি হ্যাঁ–সূচক উত্তর দিয়েছিলেন। তবে তিনি এ কথাও জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘যদি সেখানে নজিরবিহীন কোনো হামলা হয়।’ ফলে সি চিন পিং হয়তো সেই ‘নজিরবিহীন’ হামলা এড়াতে চাইবেন।

রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেন দখল করার জন্য তাইওয়ানে হামলা চালিয়েছে, সে ধরনের সক্ষমতা ও স্বভাব—কোনোটাই চীনের নেই। চীন সাধারণত সন্তর্পণে প্রতারণা ও চুরির মাধ্যমে প্রতিবেশীর ভূমি কুক্ষিগত করে থাকে।

ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণবাদের এ কৌশল নিয়ে চীন যেভাবে দক্ষিণ চীন সাগর ও হিমালয়ে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তাইওয়ানকে চেপে ধরতে সম্ভবত তারা সেই ধরনের হাইব্রিড যুদ্ধের আশ্রয় নেবে। চীনা সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে তাইওয়ানকে ঘিরে ফেলে একধরনের অবরোধ আরোপের কৌশল নিয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘তাইওয়ানকে চীনের প্রতি নতজানু হতে বাধ্য করতে পারে।’

তাইওয়ানের বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে, চীন যদি তাইওয়ান দখল করতে অভিযান চালায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৯ সালের মতোই তাইওয়ানকে ছেড়ে চলে যাবে। সে বছর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে, যদি তারা আবার তাইওয়ানকে পরিত্যাগ করে, তাহলে মার্কিন নিরাপত্তা আশ্বাসের আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। সেটি কার্যকরভাবে আমেরিকার বিশ্বব্যাপী প্রাধান্যকে শেষ করে দেবে।

ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক


অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট