সত্যিকারের জীবনে নায়ক যাঁরা, কিন্তু যাঁদের গল্প হয়তো বলা হয় না

‘তুলনামূলকভাবে অনেকটা প্রান্তিক একটি পরিবারের সন্তান ফুলপরী তাঁর লড়াইয়ে পরিবারকে পাশে পেয়েছেন, কিন্তু এই রাষ্ট্রের তুলনামূলকভাবে অনেক শিক্ষিত সামর্থ্যবান পরিবার তাদের কন্যার লড়াইয়ে পাশে থাকা দূরে থাকুক, চাপ দেয় লড়াই থেকে সরে আসতে।’

প্রতিবার একই কথা বলি, একই প্রশ্ন শুনি, প্রায় সব সময়ই চেনা মুখগুলোর অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে হয় আমাকে। নিজেকেও বলতে হয় একই কথা বারবার। নারী হিসেবে কী বাধার মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে, সেই বাধা ডিঙানোর গল্পটা কী, নারী হিসেবে রাজনীতির পথ কতটা বন্ধুর, কীভাবে সেই পথ পাড়ি দিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এবারের নারী দিবসের এক অনুষ্ঠান দেখলাম সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। প্রথম আলোর উদ্যোগে আয়োজন করা হয় একদম ভিন্নধর্মী এক অনুষ্ঠানের।

সেই অনুষ্ঠানের একজন দর্শক হয়ে কখনো কেঁদেছি, কখনো সাহসে বুক বেঁধেছি, কখনো হেসেছি সফলতার কথা শুনে, আবার কখনো মনে হয়েছে, এই গল্প তো আমারও। এ এক মিশ্র অনুভূতি। বোঝা কঠিন, বোঝানো আরও কঠিন। কথা ছিল, অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিভিন্ন অঙ্গনের সফল, সাহসী নারীরা। শোনাবেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। সমাজের প্রান্তিক অবস্থা থেকে হাজারো প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কী করে একজন নারী তাঁর নিজের ক্ষেত্রে সফল হয়ে ওঠেন, উদাহরণ তৈরি করেন, আরও লক্ষ নারীর পথ তৈরি করে দেন, তাঁদের নিয়ে ছিল এই আয়োজন। তাঁদের কথা শুনে বারবার মনে হয়েছে, যেখান থেকে আমার যাত্রা শুরু হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই যাত্রার শুরু তারও অনেক পেছন থেকে। আর ঠিক সে কারণেই আমার গল্প যতটা অনুপ্রেরণার, তাঁদের গল্প তার চেয়ে শত গুণ বেশি।  

নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি মেলে ধরেছেন একজন নারী উবারচালক, নাট্যকর্মী, নাসার আলোকচিত্রী, নারী উদ্যোক্তা, ফুটবল খেলার রেফারিসহ এমন সব পেশার মানুষ, যাঁদের সঙ্গে খুব সচরাচর আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় না। যে দেশে নিজের গাড়ি একজন নারী নিজে চালালেই একটু ভিন্ন চোখে দেখা হয়, সেখানে একজন নারী উবারচালকের পথটি খুব মসৃণ হওয়ার কথা নয়। যদিও তাঁর হাসিমাখা প্রত্যয়ী মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, নিত্যদিন ঠিক কেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। বারবার আমন্ত্রিত সব অতিথিকে তাঁর গাড়িতে চড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর হাসিমাখা মুখ, আত্মবিশ্বাসী চোখ আর ঋজু ভঙ্গি বলে দিচ্ছিল, শত বাধাতেও দমার পাত্রী নন তিনি।

অঙ্গদানকারী সারাহ ইসলামের ছবির পাশে তাঁর মা শবনম সুলতানা।

‘আমি শুনি আমি খারাপ, কিন্তু জানি না ঠিক কী কারণে আমাকে খারাপ বলা হয়...আমি তো অভিনেতা, অভিনয় করি, সাহিত্য কিংবা দর্শন পড়ি, স্টেজ সাজানো আর লাইটের কাজ করি, কাজ শেষে বাড়িতে ফিরি…’, কী সহজ সাবলীল ছিল এই নাট্যকর্মীর কথা; কিন্তু কী ভীষণ কঠিন তাঁর রেখে যাওয়া প্রশ্ন! কেন তাঁকে খারাপ বলে? এই প্রশ্ন তো অহর্নিশি আমরা, মানে মেয়েরা, যাঁরা বাইরে কাজ করি, তাঁরা নিজেকেই নিজে করি। কেন খারাপ বলে আমাদের? বাইরে কাজ করি বলে? পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে চলি বলে? নিজের কাজে শতভাগ দিতে গিয়ে অনেক সময় রাত করে বাড়ি ফিরি বলে? একা চলি বলে? নাকি আমরা সফল বলে?

নিজের কিশোর সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কলাবাগান খেলার মাঠ দখলের প্রতিবাদে নিঃশঙ্ক চিত্তে একাকী দাঁড়িয়েছিলেন যে মা, সেই সৈয়দা রত্নাও এসেছিলেন প্রথম আলোর নারী দিবসের অনুষ্ঠানে। এত লড়াইয়েও যাঁর চোখে পানি আসেনি, নিজের সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সহজেই গলা ধরে আসে তাঁর। বলেন, মানুষ বলছে, ‘স্বামী নেই তাই এত সুযোগ’। এ সমাজে নারীর স্বামী না থাকার চেয়ে বড় ‘অপরাধ’ বোধ করি আর কিছু নয়।

এমন এক সমাজে আমাদের চলতে হয়, যেখানে নারী নিজ যোগ্যতায়, স্রেফ নিজ যোগ্যতায় সফল হবেন, এ কিছুতেই মানতে পারে না সমাজ। তাই নারীর সাফল্যের পেছনে পুরুষ খোঁজে। সেই পুরুষ বাবা কিংবা স্বামী হতে পারেন, হতে পারেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কেউ। বাবা বা স্বামী হলে স্বস্তি, যাক একেবারে নিজের পায়ে ভর দিয়ে তো আর দাঁড়াননি। কিন্তু যদি বাবা বা স্বামী না পাওয়া যায়? তখনই ঘটে বিপত্তি। নারী একা তাঁর শ্রম, মেধা, যোগ্যতা দিয়ে সফল হবেন আর সমাজ তা মেনে নেবে, এত সহজ নাকি আমাদের সমাজ? তাই অবিশ্রান্ত খুঁজে চলে সফল নারীর সাফল্যের পেছনের পুরুষটিকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাল্পনিক সেই পুরুষের কাঁধে নারীর সাফল্যের বোঝা চাপিয়ে শান্ত হয় সমাজ। যাক! নারী তাঁর নিজ যোগ্যতায় সফল হননি। মুহূর্তমাত্র না ভেবে অমুকের বা তমুকের সঙ্গে যাচ্ছেতাই রটিয়ে তবে ক্ষান্ত হয় মানুষ। আমাদের সমাজে ন্যূনতম প্রমাণ ছাড়া সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে নির্দ্বিধায় যা কলঙ্কিত করা যায়, তা হলো নারীর চরিত্র। এ এমনই এক বস্তু, যা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, যাচ্ছেতাই রটাতে পারে, যেকোনো ভাষায় আক্রমণ করতে পারে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই যেকোনো কিছু ছড়াতে পারে। সবকিছুতে আমরা প্রমাণ খুঁজি, কেবল নারীর কলঙ্ক ছাড়া।  

স্বামীর সঙ্গে অদম্য মেধাবী বর্ষা রানী। ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এখন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক।

অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ফুলপরী, সঙ্গে ছিলেন তাঁর মা, বাবা আর ভাই। ফুলপরী শুনিয়েছেন তাঁর এই দীর্ঘ পথচলার গল্প। ভ্যানচালক বাবা আর গৃহিণী মায়ের ঘরে জন্ম নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতি মুহূর্ত লড়াই করে বেঁচে থাকা খুব সহজ ছিল না মেয়েটির জন্য। একবুক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মেয়েটির সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এমনটি ঘটতে পারে তাঁর সঙ্গে। এরপর চুপ থাকা কিংবা থেমে যাওয়াই হতে পারত তাঁর নিয়তি। কিন্তু না, নিয়তিকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া মানুষটি প্রতিবাদ করেছেন, মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়েছেন বিচার চাইতে। পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর পরিবার, যেটি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম। একা হাঁটা নারীর পাশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না পরিবারকে। আর তাই ফুলপরীর বাবাকে যখন বলতে শুনি ‘এটা অন্যায়! আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।’ কথাগুলো শুনে মুহূর্তের মধ্যে আমার মনে হলো, তুলনামূলকভাবে অনেকটা প্রান্তিক একটি পরিবারের সন্তান ফুলপরী তাঁর লড়াইয়ে পরিবারকে পাশে পেয়েছেন, কিন্তু এই রাষ্ট্রের তুলনামূলকভাবে অনেক শিক্ষিত সামর্থ্যবান পরিবার তাদের কন্যার লড়াইয়ে পাশে থাকা দূরে থাকুক, চাপ দেয় লড়াই থেকে সরে আসতে। ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দিতে থাকে, মেয়েদের হতে হয় প্রতিবাদহীন, মেয়েদের মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নেওয়া শিখতে সব। সবকিছু মেনে নিতে নিতে মেয়েটি একসময় ভুলতে বসেন তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা, ভুলে যান তাঁরও পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে।

প্রথম আলোর নারী দিবসের এই আয়োজন সব দিক থেকেই ছিল আলাদা। সত্যিকারের জীবনে নায়ক যাঁরা, কিন্তু যাঁদের গল্প হয়তো বলা হয় না তেমন করে, তাঁদের নিয়েই ছিল এই আয়োজন। আজ নারী অগ্রযাত্রার দূত বলে আমরা যাঁদের জানি, তাঁদের পথও মসৃণ ছিল না এতটুকু কিন্তু ফুলপরী বা সেই উবারচালক কিংবা আরও প্রান্তিক অবস্থা থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের যাত্রা আরও কঠিন, তাঁদের পথ আরও বন্ধুর। তাঁরাই প্রকৃত ‘আনসাং হিরো’। প্রথম আলোকে ধন্যবাদ, এই ‘আনসাং হিরো’দের গল্প তুলে আনার জন্য।

  • রুমিন ফারহানা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী