খটখটিয়া নদীর আধা কিলোমিটারের মালিক যখন ১১ জন

খটখটিয়া নদী

পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশে নদ-নদীর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার কোনোটিতে নেই খটখটিয়া নদীর নাম। ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব পুস্তক রচিত হয়েছে, সেখানেও নেই। ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত সিএস রেকর্ড, পাকিস্তান আমলে এসএ রেকর্ড এবং খতিয়ানে খটখটিয়া নদী আছে। নদীটির প্রবহমানতার কথা স্থানীয় লোকজনের কাছে বিস্তারিত জানা যায়।

প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে তো বটেই, কম বয়সীরাও নদীটির নিকট অতীতের প্রবহমানতা সম্পর্কে বলতে পারেন। নদীটি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার বোয়ালির বিল এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দলুয়া মৌজায় ঘিরনই নদে মিলিত হয়েছে। নদটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার।

সম্প্রতি রিভারাইন পিপলের আয়োজনে ‘খটখটিয়া নদী সুরক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। নদীপারের মানুষের উপস্থিতিতে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিভিন্ন বয়সীদের কাছে এ নদীর বর্ণনা জানা গেল।

২০২২ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খটখটিয়া নদী খনন করতে শুরু করে। তারা বিষ্ণুপুরে আধা কিলোমিটার বাদে সবটুকু খনন করেছে। এটি খনন করতে না পারার কারণ, ওই আধা কিলোমিটার কয়েকজন ব্যক্তির নামে লিখিত হয়েছে। যাঁদের নামে লিখিত হয়েছে, তাঁরা মনে করেন, এ নদীর মালিকানা তাঁদের নিজেদের। সরকারের ওই নদী খননের কোনো অধিকার নেই।

মাত্র ৩০ বছর আগেও এ নদীতে সারা বছর পানি থাকত। প্রচুর মাছ ছিল। পাবদা, ফলিসহ দেশি অনেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কেউ কেউ বলছেন, এ নদীতে পানি কমে যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলে এখন নলকূপ দিয়ে পানি তুলতে ৭০ ফুট গভীর করতে হয়। বারোমাসি নদীটি ক্রমে মৌসুমি নদীতে পরিণত হয়েছে।

রংপুর থেকে নদীটিতে যাওয়ার সময় বদরগঞ্জের বানিয়াপাড়ার কাছে ছোট ছোট দুটি বক্স কালভার্ট (ছোট সেতু) দেখতে পেলাম। নদীর প্রস্থের ছয় থেকে সাত ভাগের এক ভাগ হবে। যে নদীর উজানে প্রস্থের চেয়ে ছয় থেকে সাত ভাগের এক ভাগ সেতু হয়, সেই নদীর ভাটি কেমন হতে পারে, তা সহজে অনুমান করা যায়। মূলত ভাটিতে এ নদী মেরে ফেলার আয়োজন করা হয়েছে। নদীটির যেসব স্থানে প্রস্থের চেয়ে ছোট করে সেতু দেওয়া হয়েছে, সেসব স্থানে নদীর প্রস্থ অনুযায়ী সেতু স্থাপন করা জরুরি।

পাঁচ থেকে সাত বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) এ নদী খননের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু সেই খনন সম্পন্ন করতে পারেনি। ২০২২ সালে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নদীটি খনন করতে শুরু করে। তারা বিষ্ণুপুরে আধা কিলোমিটার বাদে সবটুকু খনন করেছে। এটি খনন করতে না পারার কারণ, ওই আধা কিলোমিটার কয়েকজন ব্যক্তির নামে লিখিত হয়েছে। যাঁদের নামে লিখিত হয়েছে, তাঁরা মনে করেন, এ নদীর মালিকানা তাঁদের নিজেদের। সরকারের ওই নদী খননের কোনো অধিকার নেই।

আরও পড়ুন

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নদীটি খনন করতে গেলে নদীতীরবর্তী গ্রাম বিষ্ণুপুরের ১১ ব্যক্তি স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র বদরগঞ্জ নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর প্রদান করা হয়। ওই পত্রে উল্লেখ করা হয় ‘বিগত ১৯৭৬-৭৭ সালে আমরা বিনিময় কবুলিয়াত মূলে নিম্নবর্ণিত তফসিলভুক্ত জমি প্রাপ্ত হই এবং তখন হইতে আমরা অন্যান্য এলাকার লোকজনের জ্ঞাতসারে ভোগদখলসহ শান্তিপূর্ণভাবে চাষাবাদ করিয়া আসিতেছি। বর্ণিত জমির ৪০, ৬২ ও বর্তমান রেকর্ড, এমনকি খাজনা খারিজ পর্যন্ত আমাদের নামে প্রস্তুত আছে।’

যে জমি বিনিময় কবুলিয়াত সূত্রে ১৯৭৬-৭৭ সালে দাবি করা হচ্ছে, সেই জমির মালিকানা ৪০ কিংবা ৬২, অর্থাৎ সিএস কিংবা এসএ রেকর্ড কিংবা খতিয়ান মূলে মালিকানা দাবি করার সুযোগ নেই। উপরন্তু বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বদরগঞ্জ জোনের সহকারী প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল হক নদীটির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আরেকটি আবেদন করেছেন। সেখানে উল্লিখিত ১১ জন ব্যক্তির আবেদনকৃত জমির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘দাখিলকৃত আবেদন ও দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায় দলুয়া মৌজার সাবেক ১ নং দাগের ১৪.৫০ একর জায়গা সিএস ও এসএ রেকর্ড অনুযায়ী সরকারি ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত।’

বদরগঞ্জ উপজেলার খটখটিয়া নদীর প্রস্থের চেয়ে ছোট সেতু। নদীটির প্রায় ১৫ একর অনেকদিন আগে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন ব্যক্তিকে কবুলিয়াত দিয়েছেন।

নদী কিংবা বিলের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার সুযোগ নেই। ব্যক্তির নামে কবুলিয়াতেরও আইনগত ভিত্তি নেই। নদীর ১৪.৫০ একর জায়গা যদি উল্লিখিত ১১ জনের নামে কবুলিয়াত হয়ে থাকে, তা আইনসিদ্ধ নয়। ফলে ওই কবুলিয়াত বাতিল করা জরুরি। যদি এই জমি সরকারের যেকোনো কর্মকর্তা ব্যক্তির নামে কবুলিয়াত দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে অন্যায়।

যে জমি নদী-খাল-বিল-জলাশয় শ্রেণিভুক্ত, সেই জমি ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয় কীভাবে? তহশিলদার, সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ইউএনও এবং সংশ্লিষ্ট কেউ-ই কি কবুলিয়াত প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন উত্থাপন করেননি! প্রবহমান নদী ব্যক্তির নামে হয় কীভাবে?

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী ২০২২ সালের জুন মাসে বন্দোবস্ত বাতিলের আবেদন করেছেন। আজ পর্যন্ত সেই বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়নি। রিভারাইন পিপল অনেক দিন আগে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে বিষয়টি লিখিত জানিয়েছে। তারও প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

কেবল আইনগতভাবে নয়, সাংবিধানিকভাবেও নদী ব্যক্তিকে কবুলিয়াত সূত্রে দেওয়ার বিধান নেই। এসব সম্পত্তি জনগণের। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কেবল অধিকতর পরিচর্যার দায়িত্বে নিয়োজিত। জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিকে দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহারও বটে। দেশের আইন কিংবা সংবিধানের চেয়ে নিশ্চয়ই কবুলিয়াত শক্তিশালী হতে পারে না।

কখনো জালিয়াতির মাধ্যমে কখনো নদীরক্ষকদের যোগসাজশে অবৈধভাবে নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া হয়েছে। এমনকি রেকর্ডও হয়েছে ব্যক্তির নামে। এত আইন, বিধি এমনকি সাংবিধানিক নির্দেশনা সত্ত্বেও নদী ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়ার ঘটনা ঘটেই চলেছে।

● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক