ট্রাম্পের কারণে পুরো বিশ্বব্যবস্থা পাল্টে যাচ্ছে

একের পর বৈশ্বিক সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

এখন সবকিছুই যেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে চলছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (দাভোস সম্মেলন) সাম্প্রতিক বৈঠকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১৯৭০-এর দশক থেকে দাভোস সম্মেলন ছিল সেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার অংশ, যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠেছিল। এখানে বিশ্বের নেতারা জড়ো হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্যের বাড়বাড়ন্ত ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বড় সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজেন। এবারের ৫৫তম সম্মেলনও ছিল সেই ধারাবাহিকতার অংশ। 

কিন্তু এবারের বৈঠক ছিল একদমই আলাদা। কারণ, সম্মেলনটি এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন। ট্রাম্পের এই ফিরে আসার মধ্য দিয়ে এমন এক যুগের সূচনা হলো, যেখানে বিশ্ব আর এক হয়ে বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করবে না। এখন আমরা এমন এক জগতে প্রবেশ করছি, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন মতে চলবে। এতে একের পর এক সংকট দেখা দেবে এবং এক কথা বা প্রতীক একেক জায়গায় একেক অর্থ বহন করবে। 

বিশ্বব্যবস্থার ভরকেন্দ্র একটি জায়গায় থাকলে অর্থাৎ এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা থাকলে শৃঙ্খলা থাকে। কিন্তু বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে শুধু যে একটি নির্দিষ্ট শৃঙ্খলার অভাব থাকে তা নয়; বরং এককেন্দ্রিক শৃঙ্খলাব্যবস্থা গড়ে তোলার আগ্রহও কারও থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও তাঁর অনুমোদন শুনানিতে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক ব্যবস্থা এখন শুধু অপ্রাসঙ্গিকই নয়, এটি এখন আমাদের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।’

এদিকে চীনের নেতারা বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোয় যা-ই বলুন না কেন, তারাও কোনো নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে নেই। ‘এক শতাব্দীতে দেখা যায়নি এমন বড় পরিবর্তন আসছে’—চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দাভোস বৈঠকে এমন মন্তব্য করলেও তিনি কিন্তু চীনের নেতৃত্বাধীন কোনো বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার কথা বলছেন না। বরং তিনি চীনা সমাজকে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার বাস্তবতা সহ্য করতে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন।

এত কিছুর পরও ট্রাম্পের বিশ্বব্যবস্থা বদলে দেওয়ার অভিলাষ বিশ্বজুড়ে আশ্চর্যজনকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস সম্প্রতি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ট্রাম্পকে সাদরে গ্রহণ করছে। তারা মনে করে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো, তাদের নিজেদের দেশের জন্য ভালো এবং তিনি বিশ্বশান্তির জন্যও সহায়ক হবেন। তাদের চাওয়া হলো যুক্তরাষ্ট্র একক কর্তৃত্ববাদী শক্তি হিসেবে না থেকে ‘স্বাভাবিক পরাশক্তি’ হয়ে উঠুক।

এখন যে বাস্তবতা, তাতে আর আশা করা যায় না ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো মাঝারি শক্তিধর দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে ধরে রাখবে। এই নতুন বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে তারা প্রত্যেকে নিজেদের শক্তিধর দেশ হিসেবেই দেখে। তারা নিজেদের প্রান্তিক অংশ হিসেবে নয়, বরং একেকটি আলাদা কেন্দ্র হিসেবে দেখতে ভালোবাসে।

ট্রাম্পকে নিয়ে শুধু ইউরোপ ও এশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশগুলোরই দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ, এত দিন তারা যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্ব ও প্রভাবকে ব্যবহার করে নিজেদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো বহুমুখী চরিত্রের সংকট। জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন নতুন প্রযুক্তি, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং পুঁজিবাদের রূপান্তর একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই সমস্যা আর্থিক বিপর্যয়ের মতো কোনো একক সংকট নয়। আর্থিক বিপর্যয় সবাইকে এক জায়গায় আনতে পারে বা সবার মধ্যে সাধারণ নিয়ম তৈরি করার আকাঙ্ক্ষা জাগায়।

এমন একটি সময় ছিল, যখন সবাই এ বিষয়ে একমত ছিল যে বৈশ্বিক শৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে এবং বিশৃঙ্খলা মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে ‘বিশৃঙ্খলা’ বলতে কোনো একক চিত্র বা কাঠামোকে বোঝানো সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এতটাই অগোছালো হয়ে গেছে যে শৃঙ্খলার ধারণাই এখন গুরুত্বহীন। উদাহরণস্বরূপ, যেসব দেশের নিরাপত্তা ও উন্নতি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করেছিল, তাদের এখন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হচ্ছে। 

ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসায় নতুন ধরনের বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করেছে। তবে এর মানে এই নয় যে দাভোস সম্মেলন বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ট্রাম্পের নীতি বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, কিন্তু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা সম্মেলনে একত্র হতে থাকবেন। কিন্তু দাভোস এবং অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর যে আগেকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ছিল, তা আর আগের মতো থাকবে না। অর্থাৎ নতুন বাস্তবতার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম নতুনভাবে সাজাতে হবে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও এখন নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনশিপের পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ