আমরা যেভাবে জীবনযাপনের ব্যয় কিছুটা কমাতে পারি

মিতব্যয়িতা একধরনের অভ্যাস। দেখছিলাম ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার। কতটা সাধারণ হতে পারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসনের জীবনযাপন। আহসান খান চৌধুরী নিজেই বলছিলেন, তিনি যে জুতা পরেছেন, কিংবা তাঁর শার্ট, প্যান্ট—সবই তাঁর প্রতিষ্ঠানেরই তৈরি। এমনকি তিনি কোনো রোলেক্স ঘড়ি পরেননি, পরেছেন ৭০০ টাকার দামের ঘড়ি। কোম্পানির টাকায় কখনো বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করেন না, সব সময় ইকোনমি ক্লাসই তাঁর পছন্দ। বিদেশে গিয়ে থাকেন সস্তা হোটেলে। বললেন, তাঁর দিব্যি চলে যাচ্ছে এবং তাঁর মনে কোনো দুঃখ নেই।
নাম শুনেও যাঁরা ভদ্রলোকের পরিচয় ধরতে পারেননি, তাঁদের জন্য বলি, আহসান খান চৌধুরী বাংলাদেশের অন্যতম সেরা উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারপারসন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, যেখানে চাকরিরত ১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী। এই কর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠানটিকে এ পর্যায়ে এনেছেন। প্রাণ আজ ১৫০টিরও বেশি দেশে এক হাজারের ওপরে আইটেমের পণ্য রপ্তানি করে। বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মধ্যে যদি টাকা অপচয় করার মানসিকতা প্রবেশ করে, আমি বোধ হয় ভালোভাবে আমার কোম্পানিকে লিড করতে পারব না।’

প্রতিষ্ঠানপ্রধানের জীবনাচরণ, আদর্শ সব সময় আশপাশের মানুষ ও সমাজের ওপর প্রভাব রাখে। এ রকম উদাহরণ আমাদের সমাজে আরও আছে। আবার বিপরীত উদাহরণও কম নয়। দুটো পয়সার মালিক হয়ে কোম্পানিমালিকের ‘লাভিস জীবনযাপনে’ কত প্রতিষ্ঠান উচ্ছন্নে গেছে।

মিতব্যয়িতা বা ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়া কেবল নিজের জন্য নয়; মিতব্যয়িতার আরেকটি মানে হলো অন্যকে সুযোগ করে দেওয়া। এটি সামাজিক বৈষম্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে স্থিতিশীলতা আনে।

সামনে কঠিন সময়। মন্দা আসছে। এ বছরের শেষেও আসতে পারে, আবার ২০২৩ সালের শুরুতেও আসতে পারে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সে আসবে, ধীরপায়ে হলেও আসবে। এখনই দরকার প্রস্তুতি। সব রকমের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ছাঁটতে হবে জীবন থেকে। প্রত্যেক নাগরিককেই রাখতে হবে কমপক্ষে ছয় মাসের আপৎকালীন তহবিল। তবে মন্দা কি তস্করের বেশে ছুরি হাতে আসবে, নাকি টর্নেডো হয়ে এসে চূর্ণবিচুর্ণ করে যাবে, তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন।

একমাত্র বাংলাদেশের মানুষই যে সংকটে আছে তা নয়; বিশ্বের সর্বোচ্চ জিডিপির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী মন্দার পূর্বাভাস দিচ্ছে। দেশটিতে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে; এর মধ্যে দুই কোটি মানুষ রয়েছে চরম দারিদ্র্যসীমার মধ্যে। আর দারিদ্র্যের কাছাকাছি মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির মতো।

তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধই যে সব সর্বনাশের মূলে, তা অন্তত আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বলা যায় না। কারণ, আমাদের রয়েছে টাকা পাচারের বিরাট অভিযোগ, প্রকল্প ব্যয়ে স্বচ্ছতার বিরাট ঘাটতি, সার্বিকভাবে জবাবদিহি ও সুশাসনের বড় অভাব। সব মিলেই আজকের অবস্থা।

মানুষ যত কষ্টেই থাকুক, যত টানাপোড়েনেই থাকুক, সন্তানের লেখাপড়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে, কেউ চায় না। তাই স্কুলের বেতন, স্কুলের কোচিং, বাইরের তিন–চারটা কোচিং চলতে থাকে। কিন্তু অভিভাবকদের মধ্যে কয়জন আছেন, যাঁরা ঠিকমতো তদারক করেন। অভিভাবকেরা যদি সন্তানের দিকে একটু মনোযোগ দেন, তবে অনেক অপ্রয়োজনীয় কোচিং এমনিতেই বাদ পড়বে।

২.

আমাদের মতো দেশে, যেখানে মোটা চালের কেজি ৫৫ টাকা, এক ডজন ডিমের মূল্য ১৬০ টাকা (সম্প্রতি দাম কমে ১২০ টাকা হয়েছে), সেখানে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের পক্ষে কোনো আপৎকালীন তহবিল গঠন করার চিন্তা একপ্রকার অবাস্তব। আয়ের অঙ্কটা যখন এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে, আর ব্যয়ের রক্তচক্ষু প্রতিনিয়তই ভ্রুকুটি দেখিয়ে চলছে। তারপরও আমরা যদি একধরনের প্রতিজ্ঞা থেকে খুব চেষ্টা করি, বাড়তি খরচের এই নিদানকালে কিছু সাশ্রয় করা হয়তো সম্ভব। একজন সাংবাদিক হিসেবে যা দেখি, যা বুঝি, সেই জায়গা থেকে কিছু কথা বলে যেতে চাই।

নাগরিক জীবনে মানুষের ব্যয়ের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বাসাভাড়া (যাদের নিজস্ব আবাসন ব্যবস্থা নেই), খাবার খরচ, যাতায়াত, পোশাক-আশাক, সন্তানের লেখাপড়া, ওষুধপথ্য। এ প্রধান পাঁচ খাতে ব্যয় কমানোর সুযোগ খুবই কম। এর বাইরে মানুষ যে খরচ করে, সেখান থেকে চাইলে কিছু সাশ্রয় হয়তো করা সম্ভব।

যেমন বাসায় ও অফিসে যাদের ইন্টারনেটের ওয়াই–ফাই সংযোগ রয়েছে, তাদের অনেকেই আবার মুঠোফোনে মাসিক প্যাকেজ নিয়ে থাকেন, মাস শেষে যার বেশির ভাগ অংশই অব্যবহৃত থেকে যায়। এটি বাদ দেওয়া যেতে পারে। এতে মাসে অন্তত ৫০০ টাকা বাঁচবে।

এরপর আসে ধূমপান। ধূমপান কর্মক্ষমতা বাড়ায়, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। একটা সিগারেটের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা। কেউ যদি দিনে ১০টি সিগারেট খায়, তার পকেট থেকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা হাওয়া। মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা, বছরে ৩৬ থেকে ৫৪ হাজার টাকা। আর সিগারেট কখনো একা খাওয়া হয় না, আশপাশের লোকজন, সঙ্গীসাথি নিয়ে খাওয়া হয়। অতএব, চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, সিগারেট ছাড়লে মাসে তিন হাজার টাকা সাশ্রয়।

যাতায়াতের ব্যয়ও কিছুটা কমানোর সুযোগ আছে। যাঁরা নিজস্ব বাহনে অফিসে বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যান, তাঁরা সপ্তাহে দুটি দিন বিকল্প ব্যবস্থায় যেতে পারেন। এতে যেমন কিছু অর্থের সাশ্রয় ঘটবে, তার চেয়ে বড় হলো, সবাই যদি এ রকম অভ্যাস করেন, বেশ খানিকটা জ্বালানি বেঁচে যাবে। আর গাড়িতে চড়া ব্যক্তি যদি মানবিক মানুষ হন, তবে সমাজের সাধারণ মানুষের জীবন আরও নিবিড়ভাবে বুঝতে পারবেন। আমাদের পাশের কলকাতা শহরে অনেক বিশিষ্ট মানুষ আছেন, যাঁরা ব্যক্তিগত বাহন রেখে হামেশাই গণপরিবহনে যাতায়াত করেন, সমাজটাকে আরও ভালো করে চেনার জন্য, বোঝার জন্য। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শেয়ারে বা ভাগাভাগি করে যাওয়া যেতে পারে, এ নিয়ে সম্প্রতি লিখেছিলাম। যাঁরা নিরাপত্তার কথা বলেছেন, আমার ধারণা, চালু হয়ে গেলে ভয় কেটে যাবে। আর যাঁদের বাসা অফিসের কাছে, তাঁরা ফেরার সময় রিকশা বা অটোরিকশা না নিয়ে হেঁটে যেতে পারেন। এতে খরচ বাঁচার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিকভাবেও চনমনে থাকা যাবে।

একটা জামা ওয়াশিং মেশিনে দেওয়া থেকে ইস্তিরি হওয়া পর্যন্ত অন্তত ২০ টাকা খরচ আছে। অথচ জামাটা এক দিন পরে অফিসে গেলেই শেষ। এরপর ওর স্থান আবার ওই মেশিনে। জামাকাপড়ের একটি অংশ যদি হাতে কাচা যায়, মাসে হাজার টাকা বাঁচানো সম্ভব।

ওষুধের খরচ কমানো কঠিন। তবে ডাক্তার সাহেবরা চাইলে এ ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রাখেন পারেন। অনেকেই আছেন, প্রয়োজনের পাশাপাশি কম প্রয়োজনের ওষুধও প্রেসক্রাইব করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কোন স্বার্থ কাজ করে, তা আর নাইবা বললাম। এই কঠিন সময়ে ডাক্তার সাহেবরা যদি রোগীর আর্থিক অবস্থা বুঝে কেবল দরকারি ওষুধটাই লেখেন, সাধারণ রোগীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।

মানুষ যত কষ্টেই থাকুক, যত টানাপোড়েনেই থাকুক, সন্তানের লেখাপড়ায় কোনো ব্যাঘাত ঘটে, কেউ চায় না। তাই স্কুলের বেতন, স্কুলের কোচিং, বাইরের তিন–চারটা কোচিং চলতে থাকে। কিন্তু অভিভাবকদের মধ্যে কয়জন আছেন, যাঁরা ঠিকমতো তদারক করেন। অভিভাবকেরা যদি সন্তানের দিকে একটু মনোযোগ দেন, তবে অনেক অপ্রয়োজনীয় কোচিং এমনিতেই বাদ পড়বে।

বাজারে প্রায়ই দেখি, মানুষ সবজির দাম শুনে দৌড় দিচ্ছেন। কারণ, বাজারে ৫০/৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই বললেই চলে, একমাত্র পেঁপে ছাড়া। যাঁরা অতিরিক্ত আনাজপাতি কিনে ঘরে জমিয়ে রাখেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার একটি অংশ নষ্ট হয়। তাই বাড়তি না কিনে প্রয়োজন বুঝে কিনলে অন্যদেরও কেনার সুযোগ তৈরি হয়। আর একবারে বেশি পরিমাণে কেনার প্রয়োজন হলে পাইকারি বাজার থেকে কিনলে সুবিধা। তাতে খরচ একটু কম হয়।

শেষ কথাটা বলে ফেলি, সপ্তাহের যেদিনই বাজার করতে যান না কেন, কেবল শুক্রবার সকালে যাবেন না। কারণ, ১০ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা বাজারে দিয়ে আসার কোনো মানে হয় না। আপনাদের মঙ্গল হোক।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    ই-মেইল: [email protected]