রাজনীতিতে ক্ষমা চাওয়ার ইতিবাচক চর্চা

Monoj Kumar Dey

রেনেসাঁ যুগের ব্রিটিশ লেখক জন লিলি তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন, ‘ভালোবাসা আর যুদ্ধে ন্যায্যতার নিয়ম প্রযোজ্য হয় না।’ তিনি রূপকার্থে এটি বললেও বর্তমানে আমরা এর ব্যবহার দেখতে পাই; বিশেষ করে রাজনৈতিক পটভূমিতে। তাই হয়তো রাজনীতিবিদেরা এমন কিছু কৌশল ব্যবহার করে থাকেন, যার মাধ্যমে তাঁরা জনগণের সহানুভূতি অর্জন করতে পারেন। জনগণের কাছে তাঁদের আগের কোনো কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিও তেমন একটি। অনেক সময় ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সঙ্গেও যুক্ত থাকে।

আমরা যদি বৈশ্বিক পটভূমির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ক্ষমা চাওয়া একধরনের ‘গুড প্র্যাকটিস’ বা ভালো চর্চা কিংবা প্রত্যাশিত একটি চর্চা হিসেবে দেখা হয়। সমাজের মানুষ যেমন একে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে, তেমনি রাজনীতিবিদেরাও এর যথাযথ মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল সেলেরমাজার তাঁর বিখ্যাত দ্য সিনস অব দ্য নেশন অ্যান্ড দ্য রিচুয়াল অব অ্যাপোলজিস বইয়ে এ ধরনের ক্ষমার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন একধরনের পাবলিক রিচুয়াল বা জনসমক্ষে পালিত আচার হিসেবে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কেননা, পশ্চিমা অনেক দেশে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা হয়, যাতে করে রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপিত হয়। সেদিক থেকে ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার একটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবেও আমরা দেখতে পারি। তাই ক্ষমা চাওয়া কেবল একটি নৈতিক প্রকাশভঙ্গি নয়; বরং এর ইতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান।

ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি যুদ্ধ কিংবা জাতিগত নিধনের পরিপ্রেক্ষিতেও আমরা দেখতে পাই। যেমন জার্মানির বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হলোকাস্টের অপরাধের জন্য নানা সময়ে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন এবং এখনো সেই ‘ক্ষমা চাওয়ার রাজনীতি’ চলছে।

বাংলাদেশের পটভূমিতে আমরা ১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিষয়টিও নিয়ে আসতে পারি, যে গণহত্যার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। গণহত্যা কিংবা হলোকাস্টের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতি তাদের অতীতের পাপমোচনের একটা সুযোগ পেয়ে থাকে। এতে করে অন্য দেশের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার মাধ্যমে একটি কার্যকর সম্পর্ক তৈরি হয়, যা তৈরি করা বর্তমান বিশ্বায়নের বৈশ্বিক পটভূমিতে জরুরি।

আমাদের দেশের পটভূমিতে এ ধরনের ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতির বিপরীতে একটি রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং ক্ষমা ও শান্তির মেলবন্ধন তৈরিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে

অপর দিকে রাজনীতিবিদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে কাজ করে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি স্তরে যেমন রাজনীতি আছে, তেমনি তার বিস্তার ও প্রভাব আমরা জাতীয় পরিসরেও দেখতে পাই। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিও আমরা বিভিন্ন সময় দেখে থাকি, বিশেষ করে নির্বাচনের ঠিক আগে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়গুলো বেশি দেখা যায়।

এটি কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যে প্রযোজ্য, বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। বৈশ্বিক পটভূমিতেও এ ধরনের কৌশলগত রাজনৈতিক আচরণ দেখা যায়। কৌশলগত হলেও একে আমরা ইতিবাচক একটি বিষয় হিসেবে দেখতে পারি, যা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে দেখা হলেও আমাদের মতো দেশগুলোয় ক্ষমা চাওয়াকে একধরনের দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। সেটি রাজনৈতিক পটভূমিতেও প্রযোজ্য।

ক্ষমা চাওয়ার যেমন একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক ফলাফল থাকে, তেমনি কোনো বিষয়ে ক্ষমা না চাওয়াকেও দেখা হয় রাজনৈতিক একটি কৌশল হিসেবে। যেমন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময়কার বিগত সরকারের দমন-পীড়ন ও শিক্ষার্থী-জনতার ওপর সহিংস হামলার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা না চাওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের জোরালো অবস্থান দেখা যায়।

এ পটভূমি ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিকে তারা হয়তো রাজনৈতিক মাঠে নৈতিক পরাজয়ের হিসেবে দেখে থাকে। আবার শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে আগে ১৯৭২-’৭৫ সালে আওয়ামী লীগের ভুলগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার অনুরোধ করেছিলেন, যা সেই সময় তাঁদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে ভূমিকা পালন করে।

আগের সব ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ জাতীয় ও সামষ্টিক পরিসরে হলেও সম্প্রতি ব্যক্তিগত পরিসরে ক্ষমা চাওয়ার উদাহরণ তৈরি করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি একটি সভায় এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বেশ আগের একটি ঘটনার জন্য ক্ষমা চান। এ ঘটনা দেশের মানুষের কাছে ইতিবাচক একটি প্রকাশভঙ্গি হিসেবে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে।

তবে তিনি যাঁর কাছে ক্ষমা চান, তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। স্বভাবতই যে প্রশ্নটি এখন আমাদের সামনে আসে সেটি হলো, বিশেষ কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ক্ষমা চাইতেন কি না? তবে এমন পরিস্থিতিতে তারেক রহমান কী করতেন, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, তাঁর এই আচরণ আমাদের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে।

আমাদের দেশের পটভূমিতে এ ধরনের ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতি, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতির বিপরীতে একটি রাজনৈতিক শিষ্টাচার এবং ক্ষমা ও শান্তির মেলবন্ধন তৈরিতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এ ধরনের চর্চা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক বদলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবেও রয়ে যাবে। আমাদের দেশের নানা হতাশার মধ্যে এই ছোট ছোট প্রকাশভঙ্গি আমাদের আশাবাদী হতে স্বপ্ন দেখায়।

  • বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

    মতামত লেখকের নিজস্ব