কিউবা কি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্বের বলি হতে চলেছে?

১৯৬২ সালের অক্টোবরে বিশ্ব ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’ নামে এক পারমাণবিক গণহত্যার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
ছবি: এএফপি

আমরা সবাই গল্পটা শুনেছি। ১৯৬২ সালের অক্টোবরে বিশ্ব ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’ নামে এক পারমাণবিক গণহত্যার একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন খলনায়কের মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র দেড় শ কিলোমিটার দূরে কিউবার একটি দ্বীপে জড়ো করার উদ্যোগ নিয়েছিল। যে গল্পটা হারিয়ে গেছে বা এখনো অজানা, তা হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন এই উদ্যোগ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র পরমাণুসমৃদ্ধ জুপিটার মিসাইল তুরস্কে বসানোর পর।

৬০ বছর পরও কিউবা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটা অস্বস্তির নাম। কিউবা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের শ্বাসরোধকারী নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। আর এই নিষেধাজ্ঞার সূত্রপাত হয়েছিল মিসাইল সংকটের সময়, যেটিকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ক্ষমতাবলে গণবিধ্বংসী বলে আখ্যা দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের আর নাম-নিশানা নেই এখন। কিন্তু শত আঘাতেও বিরক্তিকরভাবে ঘুরে দাঁড়ানো দেশ কিউবা এখন অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ানো চীনের পাশে দাঁড়াতে চাইছে।

সরকার পরিবর্তন হোক বা না হোক, বোল্টন চান কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ছিন্ন করুক। চীন ও তার ট্যান্ডল কিউবার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হোক। কিউবায় অবৈধ কারাগার এবং নির্যাতন সেল চালু রাখা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি কী করবে বুঝে উঠতে না পারে, তা নিয়েও বোল্টনের পরামর্শ আছে। তিনি বলছেন, ‘গুয়ানতানামো বে, উদাহরণ হিসেবে কখনোই কাস্ত্রোবিরোধী কার্যক্রম চালানোর জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু এখনো গুয়ানতানামো বে আমাদের আয়ত্তে আছে।’

দক্ষিণপন্থী সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ৮ জুন অত্যন্ত উদ্বেগাকুল হয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। তারা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রকে মাথায় রেখে ‘চীনাদের গুপ্ত ঘাঁটি’ চালু হতে যাচ্ছে কিউবায়। বেইজিং হাভানাকে আড়ি পাতার যন্ত্রপাতির জন্য বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। এই একই সংবাদপত্রে ২০ জুন চীন-কিউবার মধ্যে যৌথ মহড়ার আয়োজনের খবর প্রকাশ করে। তারা বলে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘরের দরজায় চীনা সেনাবাহিনী এল বলে।

এ খবরের সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি, তবে এই অবকাশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঠিকই ভণ্ডামি করে চলেছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মনে করে, এই সমীকরণে চীন হলো আগ্রাসী পক্ষ। যদিও তারা স্বীকার করে যে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে নজরদারি করছে, তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি করছে এবং গুয়ানতানামো বেতে সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করছে। এই ঘাঁটি আবার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন অংশের কাছে সরবরাহ করছে।

এই একই পত্রিকা গত ফেব্রুয়ারিতে লিখেছে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানে বড় সংখ্যক সেনাসমাবেশ করছে। শত্রুপক্ষের দোরগোড়ায় বা ঠিক তাদের উপকূলের কাছে। আর যৌথ মহড়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে মিশিগান ন্যাশনাল গার্ড যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তাইওয়ানের সেনা সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ায় ব্যস্ত।

অবশ্যই সব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে হারিয়ে দিয়েছে। যেমন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আড়ি পাতা, দেশের সীমানার বাইরে গিয়ে অন্য দেশের রাজনীতিতে নাক গলানো থেকে শুরু করে বোমা মেরে অন্য দেশের মানুষকে ভয় দেখানো পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তারা যেখানে যা খুশি তা–ই করতে পারে। অন্য কোনো দেশের যদি একই আচরণ করার দূরতম সম্ভাবনাও দেখা যায় তাহলে তাকে অমার্জনীয় বর্বর আচরণ বলে ধরা হয়। বিশেষ করে এসব ঘটনা যদি তাদের বাড়ির উঠানে ঘটে।

এ বছরের শুরুর দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা চীনের ‘স্পাই বেলুন’ নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন কিউবা-চীনের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছিল। এ অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের আবাসিক ভাড়াটে সৈনিকেরা আরও উসকে দেয়। সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য হিল ‘কেস ইনপয়েন্ট’ নামে মার্কিন কূটনীতিক ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এ প্রবন্ধে তিনি নিজেকে অন্য দেশে অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনাকারী বলে দাবি করেছেন।

বোল্টন যুক্তি দেন, কিউবায় অনুপ্রবেশ করে চীন আসলে তার আধিপত্য বিস্তারের যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণ করছে। তাদের এই উদ্যোগ ’৬০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতির সমকক্ষ। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই চিন্তা করা উচিৎ কীভাবে ও কখন  কাস্ত্রো–পরবর্তী সরকার উৎখাত করা  যায়।

সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট অভ্যুত্থান তো আর কখনোই অনুপ্রবেশ বলে বিবেচিত হবে না।

সরকার পরিবর্তন হোক বা না হোক, বোল্টন চান কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ছিন্ন করুক। চীন ও তার ট্যান্ডল কিউবার ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হোক। কিউবায় অবৈধ কারাগার এবং নির্যাতন সেল চালু রাখা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি কী করবে বুঝে উঠতে না পারে, তা নিয়েও বোল্টনের পরামর্শ আছে। তিনি বলছেন, ‘গুয়ানতানামো বে, উদাহরণ হিসেবে কখনোই কাস্ত্রোবিরোধী কার্যক্রম চালানোর জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু এখনো গুয়ানতানামো বে আমাদের আয়ত্তে আছে।’

এদিকে ২৭ জুন ফক্স নিউজ সাবেক একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং টেক্সাস পাবলিক পলিসি ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি চাক ডিভোরকেকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘চীন কিউবায় যা করছে, তা আমাদের জন্য বড় হুমকি।’ তিনিও কিউবার সরকার পতনের পক্ষের লোক ছিলেন এবং যুক্তি দেখান চীন হয়তো কিউবাকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তুলবে। এর সমাপ্তি হবে হয়তো তাইওয়ানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এলে।

  • বেলেন ফার্নান্দেজ আল-জাজিরার কলাম লেখক

    আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত