বিশ্ব রাজনীতিতে অপরাধীদের নির্বাচিত হওয়ার তালিকা বড় হচ্ছে

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়ে ফের একই পদে নির্বাচন করার ঘটনা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একধরনের স্বাতন্ত্র্যযুক্ত প্রথম সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাঁড় করালেও প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার ইতিহাসে তিনিই প্রথম কোনো রাজনৈতিক প্রার্থী নন, যাঁকে অভিযুক্ত কিংবা দোষী সাব্যস্ত, এমনকি কারারুদ্ধ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ট্রাম্পের জ্বালানিমন্ত্রী ও টেক্সাসের সাবেক গভর্নর রিক পেরি যখন ২০১৬ সালে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি অভিযোগ মুলতবি অবস্থায় ছিল। 

এরপর ১৯২০ সালে আটলান্টা ফেডারেল পেটেনশিয়ারি থেকে প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করা ইউজিন ডেবস-এর কথা বলা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে ১৯১৮ সালের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাঁর ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে ডেবস প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করতে পারেননি। তবে তিনি প্রায় ১০ লাখ ভোট পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে এযাবৎকালে তিনিই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। 

আরও পড়ুন

এর মধ্যে এমন অনেক প্রার্থী আছেন, যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ভোটের দৌড়ে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র নির্বাচনে ম্যারিয়ন এস ব্যারি জুনিয়র মাদক রাখার জন্য ছয় মাস কারাভোগ করা সত্ত্বেও ১৯৯৪ সালে ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র হিসেবে চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হয়েছিলেন।

 যদিও গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় বিশিষ্ট সরকারি পদগুলো সুরক্ষিত করার জন্য আগে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রার্থিতাকে অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তবে এ ধরনের লোকের রাজনৈতিক সাফল্যের কথা যে একেবারেই শোনা যায় না, তা নয়। কখনো কখনো এটি গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত থাকে।

বর্ণবাদী সরকারের দ্বারা ২৭ বছর কারাভোগের পর দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। দুর্নীতির দায়ে ১২ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে অতি সম্প্রতি ২০২২ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কারাদণ্ডের রায় বাতিল ঘোষণার আগে লুলাকে দুই বছরের কিছু কম সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছে। আরও অনেকে আছেন যাঁরা জেলে থাকার সুবাদে রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হয়েছেন।

হিটলার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। ১৯২৩ সালে মিউনিখে তাঁর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের আগে হিটলার অপরাধমূলক রেকর্ডধারী হিসেবে তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত নেতা ছিলেন। ‘বিয়ার হল’ অভ্যুত্থানচেষ্টার সাজা হিসেবে হিটলারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। হিটলার ল্যান্ডসবার্গ কারাগারে মাত্র ৯় মাস বন্দী ছিলেন। এই সময়টাতেই তিনি তাঁর ইহুদিবিরোধী ইশতেহার মাইন কাম্ফ লিখেছিলেন। মুক্তি পাওয়ার সময় তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এক দশকের কম সময়ের মধ্যে আমজনতাকে উন্মত্ত করা নেতা হিটলার জার্মানির ‘ফুয়েরার’ হিসেবে আবির্ভূত হন। 

জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের দাদা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিশি নোবুসুকে আরেকটি বড় উদাহরণ। কিশি তাঁর দেশের সে সময়কার আমলাতান্ত্রিক অভিজাত গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যেমনটি হিটলার ছিলেন না। কিশিকে হিটলারের যুদ্ধাস্ত্রবিষয়ক মন্ত্রী আলবার্ট স্পিয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যাঁকে দাস নির্যাতনের নুরেমবার্গ ট্রায়ালে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কিশি গ্রেপ্তার হলেও এবং সাড়ে তিন বছর তিনি জেলে থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে কখনোই বিচারের মুখে পড়তে হয়নি বা দোষী সাব্যস্ত হতে হয়নি। জেলে থাকার সময়ই কিশি বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করেছিলেন। এসব সঙ্গী বন্দীর মধ্যে একজন কুখ্যাত গ্যাংস্টার ও একজন জাপানি ফ্যাসিস্টও ছিলেন।

আরও পড়ুন

আমেরিকানরা যখন ঠিক করল, জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে চীনা ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রীদের বিরোধিতা করা বেশি জরুরি, তখন আমেরিকানরা বুঝল, কিশিকেই তাদের প্রয়োজন। মুক্তি পাওয়ার পরপরই কিশি জাপানকে কমিউনিস্টবিরোধী ও মার্কিন মিত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে আমেরিকানদের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ট্রাম্প একনায়কও নন, আবার যুদ্ধাপরাধীও নন। তিনি এমন একজন ‘দূষিত আত্মপ্রচারকারী’ যিনি কিনা রাজনৈতিক এবং আর্থিক লাভের জন্য তাঁর আইনি সমস্যাগুলো কাজে লাগাতে চাইছেন। একজন স্বঘোষিত অনাহুত রাজনীতিক হিসেবে তিনি তাঁর ভিন্নমতকে রাজনৈতিক সম্পদে পরিণত করেছেন। তিনি নিজেকে দুর্নীতিবাজ অভিজাতদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়া একজন ‘শহীদ’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন।

এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে যে ট্রাম্পের কৌশল কাজ করছে। তাঁর বিরুদ্ধে তোলা প্রতিটি নতুন অভিযোগ রিপাবলিকান ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে এবং তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণাকে আরও জোরালো করেছে।

ট্রাম্পের মোটর শোভাযাত্রা, উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং বিচারক ও কৌঁসুলিদের লক্ষ্য করে আক্রমণ ও উপহাস মিডিয়ায় তাঁর চাঞ্চল্যকর উপস্থিতির জানান দিয়েছে।

ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত জিতে যান, তাহলে তাঁর সেই বিজয় হিটলারের ১৯৩৩ সালের অভ্যুত্থানের মতো কিছু হবে না; তবে সেই বিজয় ১৯৫০–এর দশকের শেষ ভাগের কিশির শাসনাধীন জাপানের চেয়ে খারাপ কিছু হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল বইয়ের লেখক