ইইউর নতুন নির্দেশিকা পোশাকশিল্পের জন্য নতুন সুযোগ এনে দিতে পারে

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নতুন সামাজিক ও পরিবেশগত নির্দেশিকা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য কি বাধা হয়ে দাঁড়াবে, নাকি ব্যবসার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে?

২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে ইইউ করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স নির্দেশিকা (ইউসিএসডিডিডি) কার্যকর হয়। এ আইন সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ডকে ব্যবসায়িক নীতির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে। এই নতুন নিয়মাবলি বিশ্বজুড়ে বিতর্কের সূচনা করেছে।

এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। কারণ, কঠোর সামাজিক ও পরিবেশগত মানদণ্ড পোশাক রপ্তানি-বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন থামিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে ইউরোপীয় সমর্থকেরা ইউসিএসডিডিডিকে মানবাধিকার ও পরিবেশ রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রশংসা করছেন।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক ধারাকে সমুন্নত রাখার জন্য শিগগিরই এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন এবং বিশ্বব্যাপী সামাজিক ও পরিবেশগত টেকসই মানদণ্ডকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

ইইউ নির্দেশিকায় কী আছে

বড় বড় ইউরোপীয় করপোরেট সংস্থা এবং যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করে, তাদের বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধ এবং পরিবেশগত ক্ষতি হ্রাস করতে দায়িত্বশীল হতে জোর দেওয়া হয়েছে ইইউ নির্দেশিকায়। এই রূপান্তরমূলক নীতি ৯ হাজার ৪০০টির বেশি বড় কোম্পানি এবং প্রায় ৩ হাজার ৪০০টি উচ্চ প্রভাবিত খাত, যেমন টেক্সটাইল ও খনিজ শিল্প কোম্পানিকে আরও দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক কার্যক্রম গ্রহণের দিকে পরিচালিত করবে।

এ ছাড়া যেসব ছোট কারখানা বড় কোম্পানিগুলোর সাবকন্ট্রাক্টর বা সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করে, তাদের ওপরও কঠোর এসব মানদণ্ড মেনে চলতে নির্দেশিকা প্রভাব বিস্তার করবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই নতুন আইন জাতিসংঘের নিয়মকানুন ও ওইসিডিরদিকনির্দেশনার আলোকে করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ইউরোপীয় সংসদের একটি প্রতিবেদন আইনটি তৈরিতে সাহায্য করেছে। এই আইনের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় কমিশন মানবাধিকার, পরিবেশ রক্ষা ও অর্থনীতির উন্নতি—এই তিন বিষয়কে একসঙ্গে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এই প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও পরিবেশসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তির উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

স্বেচ্ছাসেবী সার্টিফিকেশন ও ইউসিএসডিডিডি

গত কয়েক দশকে অনেক পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশি কোম্পানি বেসরকারি সার্টিফিকেশন সংস্থা, যেমন এসএ ৮০০০, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ বা ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের অধীন সার্টিফায়েড হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। এসব সনদ পাওয়ার জন্য নিরীক্ষা, কাগজপত্র ও প্রশাসনিক খরচ তুলনামূলক বেশি লাগে, যা ছোট কোম্পানিগুলোর জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে।

দক্ষিণ ডেনমার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৩ হাজার সার্টিফায়েড অডিটর ও পরামর্শদাতা প্রতিবছর মোট প্রায় ২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা করে থাকেন। এ ছাড়া এসব সার্টিফিকেশনের বাজার-স্বীকৃতি সব সময় নিশ্চিত নয়, ফলে ক্রেতারা সার্টিফিকেশন থাকা বা না-থাকা যেকোনো কোম্পানিকে বেছে নিতে পারে। এ কারণে ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না।

বেসরকারি সার্টিফিকেশনগুলো প্রায়ই কিছু মানুষ দ্বারা তৈরি নির্দেশিকা, যা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মালিকানাধীন হয়। শ্রম ও পরিবেশগত নির্দেশিকাগুলো মেনে চলা ঐচ্ছিক ও প্রয়োগের কৌশল সাধারণত দুর্বল হয়। অন্যদিকে ইউসিএসডিডিডি ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বারা প্রণীত ইউরোপীয় ক্রেতা ও তাদের সরবরাহকারীদের জন্যও একটি নীতিগত বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।

যেসব আন্তর্জাতিক ক্রেতা কোম্পানি এই নতুন ইউরোপীয় আইন মেনে চলতে ব্যর্থ হবে, তারা ইউরোপীয় বাজার থেকে বাদ পড়তে পারে অথবা জরিমানাসহ নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্রগুলো দ্বারা জাতীয় আইন প্রয়োগ পদ্ধতি কার্যকর হবে।

এ ছাড়া ইউসিএসডিডিডির পরিসর বেসরকারি সার্টিফিকেশন সংস্থাগুলোর তুলনায় ব্যাপক, যা সাপ্লাই চেইনজুড়ে পরিবেশ ও মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ আইন অনুসারে, কোম্পানিগুলোকে দূষণ, শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন ও সম্পদ আহরণের মতো সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব শনাক্তকরণ, হ্রাস ও প্রতিরোধ করতে হবে।

নির্দেশিকার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, মানবাধিকার হিসেবে জীবনধারণযোগ্য মজুরি এবং জীবনধারণযোগ্য আয়ের স্বীকৃতি, যা কোম্পানিগুলোকে তাদের পরিচালনাগত কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করবে। বাধ্যতামূলক পালনীয়, ব্যাপক পরিসর, প্রয়োগ ও স্বচ্ছতার ওপর জোর দেওয়া ইউসিএসডিডিডি, বেসরকারি সার্টিফিকেশনের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। যেসব বাংলাদেশি পোশাক ও টেক্সটাইল ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয় ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক, তাঁদের অবশ্যই ইউসিএসডিডিডি নীতিমালা মেনে চলতে হবে।

শ্রমিকদের মজুরি ও মর্যাদা মজুরি

ইউসিএসডিডিডি বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল ব্যবসার জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করলেও এটি ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। ইউসিএসডিডিডির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হলে প্রচুর সময় ও আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়বে। শ্রমিক অধিকার ও কর্মপরিবেশের উন্নতি, পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে।

সমস্যাটি আরও জটিল হয়; কারণ, বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প মূল্য সংবেদনশীল, উচ্চ উৎপাদন ও কম মুনাফার ব্যবসা মডেল অনুসরণ করে। যেহেতু বাংলাদেশে জীবনধারণযোগ্য মজুরি নিয়ে কোনো আইন নেই, তাই মজুরি-ব্যবস্থা, মূল্য নির্ধারণ মডেল ও সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন এবং সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিচালনা পুনর্বিন্যাস করে এসব উন্নত মানদণ্ড মেনে চলতে জোর দেওয়া প্রয়োজন, যাতে স্বচ্ছতার সঙ্গে ইউরোপীয় বাজারে ব্যবসার প্রসার ঘটতে পারে।

পোশাকশিল্পে সামগ্রিক প্রভাব

বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান ভিত্তি। এই শিল্প বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ রাজস্ব জোগায়। এই শিল্প দেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ এই খাতে নিযুক্ত, যাঁদের অধিকাংশই নারী। এতে করে নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটে।

বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের জন্য ইউরোপীয় বাজারের প্রবেশাধিকার ধরে রাখা অপরিহার্য। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ৩৮ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের পণ্য ইউরোপে রপ্তানি করেছে, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শুধু তৈরি পোশাক থেকেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ আয় হয়েছে। ইউরোপীয় পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পোশাক ও টেক্সটাইল রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ ইউরোপে যায়। তাই ইউসিএসডিডিডির ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

চ্যালেঞ্জকে কীভাবে সুযোগে পরিণত করা যায়

বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ, নতুন ডিজিটাল টুলস ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত এই সেক্টরকে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা।

তা ছাড়া ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো ও স্থানীয় টেক্সটাইল কারখানাগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি, যা ইউসিএসডিডিডি যে প্রভাব তৈরি করতে চায়, তা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইউরোপীয় পোশাক ব্র্যান্ডগুলোর উচিত নতুন কৌশল ও পদ্ধতি তৈরি করা, যাতে করে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রবেশাধিকার সমুন্নত থাকে।

এর বাইরে ইউসিএসডিডিডির বাস্তবায়নে শ্রমিক, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিশেষত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে সবার অংশগ্রহণ ও কাজের সুযোগ সমুন্নত থাকে এবং ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।

আশা করা যায়, ইউসিএসডিডিডির মানদণ্ডগুলো মেনে চলার মাধ্যমে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প ইউরোপীয় বাজারে একটি প্রতিযোগী-সুবিধা লাভ করবে এবং নিয়ম মেনে উৎপাদিত পণ্যের প্রতি আগ্রহী গ্রাহকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে পারবে। এই নতুন আইন ইউরোপীয় বাজারের সঙ্গে বাণিজ্য-সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারে, যা বাংলাদেশকে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে আলাদা করে তুলবে।

  • শতদ্রু চট্টোপাধ্যায় নেদারল্যান্ডসভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিডাডের এশিয়া অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক