পুতিনের সামনে কেন আর কোনো বিকল্প নেই?

ভিড় এড়াতে অনলাইনে ভোট দিয়েছেন পুতিনফাইল ছবি রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কী ফলাফল হবে, সেটা এরই মধ্যে সবার জানা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অন্যান্য প্রতিযোগীর কাছ থেকে খুব সামান্যই প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন। কেননা, প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যাঁরই জনসমর্থন পাওয়ার সামান্য সম্ভাবনা ছিল, তাঁর প্রার্থিতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

সাবেক টেলিভিশন সাংবাদিক ইয়েকাতেরিনা দান্তসোভা গত নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আবেদন জমা দেওয়ার কিছুদিন পরেই তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

ক্রেমলিনের পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে জনগণের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। উদারপন্থী রাজনীতিবিদ বরিস নাদেজদিন। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তাঁকেও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। কেননা, পুতিনবিরোধী ভোটারদের মনোযোগ কাড়ছিলেন তিনি।

এটা স্পষ্ট, পুতিন কোনোভাবেই চান না যে তাঁর বিজয় প্রশ্নবিদ্ধ হোক। ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর নীতিগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে চান। এর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে ইউক্রেনে তাঁর ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’।

একটা ভূমিধস বিজয়, রুশ সমাজ পুতিনের যুদ্ধকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছে, সেটা ‘প্রমাণিত’ হবে। একই সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো সেনাবাহিনীতে বড় আকারের নিয়োগের মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার ভিত্তিও গড়ে দেবে। পুতিনের পরিকল্পনা হলো বড় ধরনের অভিযানের জন্য যথেষ্টসংখ্যক সেনা সংগ্রহ করা।

নতুন এই হামলার উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং খারকভ, ওদেসা ও সম্ভবত কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া। এরপর পুতিন আশা করছেন, এবারে মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতবেন এবং তাঁর সঙ্গে তিনি রাশিয়ার শর্ত অনুসারে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবেন।

নির্বাচনে কমসংখ্যক ভোটার যদি ভোট দিতেন, তাহলে সেটা বিরোধীদের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু পুতিন যদি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোটে জেতেন, তাহলে সেটিকে দেশজুড়ে তার সমর্থন বলে ধরে নিয়ে সেটাকে ক্ষমতা আরও সংহত করতে এবং ইউক্রেন ও ইউরোপে সামরিক উত্তেজনা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করবে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পেছনে ক্রেমলিন এতটা মরিয়া হওয়ার কারণ হলো, তারা বুঝতে পারছে রাশিয়ার জনগণ যুদ্ধ নিয়ে এখন আর ততটা উৎসাহী নয়।

সম্প্রতি ভোটকেন্দ্রিক সব সরকারি জরিপের ফলাফল বলছে, যুদ্ধের প্রতি উচ্চমাত্রার সমর্থন (৭০ শতাংশ) ব্যক্ত করেছে। কিন্তু তাদের জরিপের এই পদ্ধতি সংকীর্ণ প্রশ্নের ওপর করা হয়েছিল, ‘আপনি কি বিশেষ সামরিক অভিযান সমর্থন করেন?’
রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সমালোচনা করলে শাস্তির বিধান রেখে যে আইন পাস হয়েছে, তাতে অনেকেই যুদ্ধের বিরোধিতা করে কথা বলতে ভয় পান। সে ক্ষেত্রে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা যে ‘না’ বলে নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। ক্রেমলিন সেটা ভালো করেই জানে।

স্বাধীন জরিপকারী সংস্থা ক্রনিকলস প্রজেক্ট জনগণের এই ভয়কে বিবেচনায় নিয়ে আরও প্রশ্ন যোগ করে জনগণের মনোভাব শনাক্ত করার চেষ্টা করেছে। তাদের প্রশ্নের মধ্যে ছিল, ‘আপনি কি অভিযান শেষ হোক, তা চান?’ কিংবা ‘কেন্দ্রীয় বাজেটে সেনাবাহিনীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে—সেটা তাঁরা চান কি না?’ এই জরিপে বেরিয়ে এসেছে, যুদ্ধের প্রতি অব্যাহত সমর্থন ব্যক্ত করেছেন মাত্র ১৭ শতাংশ।

নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী, সমরশিল্পে যুক্ত ব্যক্তিরা রয়েছেন। রাশিয়ার সমরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এখন সরকারের কাছ থেকে বড় বড় কাজের আদেশ পাচ্ছেন।

টেলিগ্রাম চ্যানেলে সরকারপন্থী ব্লগার যাঁরা যুদ্ধ নিয়ে লিখছেন, তাঁদের লেখার মূল বার্তাটি হলো, যুদ্ধ নিয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অবজ্ঞা-প্রদর্শন। তাঁরা অব্যাহতভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন, সাধারণ রুশরা যুদ্ধক্ষেত্রে কী হচ্ছে, তা নিয়ে খুব কম আগ্রহী এবং বিশেষ অভিযান নিয়ে তাঁরা অনেক সময় বৈরিতার মনোভাব দেখাচ্ছেন।

প্রকৃতপক্ষে, জরিপে অংশ নেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধ সমর্থনের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’সূচক উত্তর দিয়েছেন, সাধারণভাবে তাঁরা সংঘাত নিয়ে চিন্তা করতে কিংবা রাজনীতিতে জড়াতে না চাওয়া মানুষ। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, এই যুদ্ধ অনিবার্য ছিল এবং এতে তাঁদের কিছু করার নেই।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে নিঃসন্দেহে অসহায়ত্ব বলে। দশকের পর দশক ধরে নিপীড়ক সরকারের অধীন থাকার ফল। এই নীরবতা ও অক্রিয় অবস্থান তাদের অস্তিত্বের কারণেই। এটাকেই অনেক সময় ভুলভাবে পুতিন সরকার ও তাঁর যুদ্ধের প্রতি সমর্থন বলে ধরে নেওয়া হয়।

একই সঙ্গে আবার বিশাল একটি অংশ—প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ—পুতিনের যুদ্ধ ও সরকারের নীতির খোলাখুলি বিরোধিতা করেছেন। এসব লোক গণতান্ত্রিক ও যুদ্ধবিরোধী। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে এই গণতন্ত্রপন্থী ও যুদ্ধবিরোধী রাস্তায় নেমে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। দেশজুড়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছিল। এই আটকই বলে দেয়, তখন কী মাত্রায় বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছিল।

বিরোধী রাজনীতিবিদ অ্যালেক্সি নাভালনির শেষকৃত্যে অভূতপূর্ব গণ-অংশগ্রহণও প্রমাণ করে পুতিনবিরোধী মনোভাব কতটা বেড়েছে। শেষবিদায় জানাতে হাজার হাজার মানুষ সমাধিস্থলে আসেন। তাঁরা এমন একজন রাজনীতিবিদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, যিনি তাঁর পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উৎসর্গ করেছেন।

এর বিপরীতে যুদ্ধপন্থী নেতা, যেমন ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের শেষকৃত্যে কিংবা সুপরিচিত যুদ্ধ সংবাদদাতা ভ্লাদেন তাতারক্সির শেষকৃত্য এতটা জনস্রোত দেখা যায়নি।

রাশিয়ার অরাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে প্রেসিডেন্ট, তাঁর নীতি ও রাশিয়ার অবনতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক কী, সেটা সরাসরি বুঝতে পারা কঠিন। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের জীবনযাত্রার মান ও জীবনযাপন পরিস্থিতি বিষয়টি সরাসরি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বড়জোর গভর্নরের সঙ্গে জড়িত। ব্যক্তি পুতিন তাঁদের ভাবনা থেকে সব সময়ই অনেক দূরে।

নির্বাচনে কমসংখ্যক ভোটার যদি ভোট দিতেন, তাহলে সেটা বিরোধীদের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু পুতিন যদি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভোটে জেতেন, তাহলে সেটিকে দেশজুড়ে তার সমর্থন বলে ধরে নিয়ে সেটাকে ক্ষমতা আরও সংহত করতে এবং ইউক্রেন ও ইউরোপে সামরিক উত্তেজনা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করবে।

  • বরিস বনদারেভ, রাশিয়ার সাবেক কূটনীতিক
    আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত