বাজেটে কর-ঋণের বোঝা এবং সর্বজনের প্রশ্ন

অর্থনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিছক অর্থনীতির বিষয় নয়, এটা সমাজের শক্তি সমাবেশ ও ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্তমানে যেভাবে চলছে, অনেকের উৎপাদিত সম্পদ কিছুজনের হাতে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া কিংবা কিছুজনের স্বার্থে বহুজনের জীবন বিপন্ন করা কোনো স্বয়ংক্রিয় ঘটনা নয়।

তা নির্দিষ্ট নীতি, পরিকল্পনা ও রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডের ফল। বাংলাদেশে সরকার তার নীতিদর্শন অনুযায়ী দেশে লুম্পেন পুঁজিপতি বিকাশে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। সর্বজনের সম্পদ কিছুজনের হাতে পৌঁছানো তাই সরকার দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। বর্তমান বাজেট তারই একটি আইনি ব্যবস্থামাত্র।

সামগ্রিক যে নীতিকাঠামোর অধীন তিন দশকের বেশি সময় ধরে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, যা আরও শক্তি পেয়েছে গত এক দশকে, তার মূল কথা হলো—১. জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব হ্রাস, ২. ক্রমাগত মানুষকে বাজার বা কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেওয়া, ৩. রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানা, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, শিক্ষা-চিকিৎসা এবং সর্বজনের মালিকানাধীন সম্পদ যেমন পানি, বন, খালবিল, উন্মুক্ত স্থান ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক তৎপরতার জন্য ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে যাওয়া। ৪. কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ।

এসবের ফলাফল হিসেবে শিক্ষা ও চিকিৎসা—দুটিই এখন ব্যয়বহুল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত বহুজাতিক পুঁজি এবং দেশীয় কতিপয় গোষ্ঠীর দখলে। এর ধারাবাহিকতায় অনেক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকট দেখা দিয়েছে, সরকারি–বেসরকারি বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে, আন্তর্জাতিক রেটিং কমেছে, দেশ থেকে সম্পদ পাচার বেড়েছে। সব চাপ শেষ পর্যন্ত পাবলিক বা সর্বজনের ওপর।

সম্পদ স্থানান্তরের আইনি ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক আছে। মুদ্রাব্যবস্থা তার একটি। ১৯১৯ সালে প্রকাশিত দ্য ইকোনমিক কনসিকুয়েন্স অব পিস গ্রন্থে কেইনস বলেছিলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতির অব্যাহত চাপ রেখে সরকারগুলো খুব গোপনে, অলক্ষ্যে তাদের নাগরিকদের সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হজম করে ফেলে। এ পদ্ধতিতে হজম বা বাজেয়াপ্ত করার এই ঘটনা ঘটে নির্বিচার। এ প্রক্রিয়ায় যখন বহুসংখ্যক মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তখন কিছুসংখ্যক সম্পদশালী হয়।’ মুদ্রাস্ফীতি বিভিন্নভাবে ঘটে বা ঘটানো হয়।

এর মাত্রা সব ক্ষেত্রে এক রকম হয় না, আবার তা সব সময় খোলামেলাও থাকে না। টাকার তুলনায় ডলারের দাম ক্রমাগত বেড়ে গেলে রপ্তানিকারক গার্মেন্টস মালিকদের আয় বাড়ে। কিন্তু তাতে দেশের শ্রমিকসহ সবার আপেক্ষিক আয় কমে। আমদানি করা দ্রব্যাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় থেকে শুরু করে গৃহস্থালি ব্যয় সবকিছুই বাড়ে, সামগ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওপর চাপ বাড়ে। ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও বাড়ে। সংখ্যাগুরু মানুষের প্রকৃত আয় ও সঞ্চয় কমে যায়।

সমাজে এই প্রশ্নগুলো তাই জোর গলায় তুলতে হবে, কেন ব্যাংকগুলো এত লুণ্ঠনের শিকার হলেও তার অপরাধীরা মহা দাপটে থাকতে পারে? কেন লুট বন্ধ না করে জনগণের টাকা থেকে সেখানে ভর্তুকি দেওয়া হয়? কেন কতিপয় গোষ্ঠীর বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয় ক্যাপাসিটি চার্জের নামে? কেন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি?

আরেকটি ব্যবস্থা রাজস্বনীতি। বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয়, তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর শুল্ক, ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেওয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয়? সেটি হলো সরকারি প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। সরকারি–আধা সরকারি প্রতিটি গাড়ি, প্রতিটি ভবন, এসি, সভা, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া, বিলাস, অপচয়, জীবনযাপন, বিদেশ সফর, কেনাকাটা প্রকৃতপক্ষে জনগণের অর্থেই পরিচালিত হয়। জনগণ হয়তো খেয়াল করে না যে তাদের ঘরের ওপর বুলডোজার, তাদের মাথায় পুলিশের লাঠি, তাদের সামনে মন্ত্রী–এমপি–আমলার চোটপাট কিংবা শানশওকত, নতুন নতুন ভবন, দামি গাড়ি—সবই তাদের অর্থেই হয়।

জনগণের কাছ থেকে কর– শুল্ক সারচার্জ বা বর্ধিত দাম আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের সাধারণত কোনো ব্যর্থতা দেখা যায় না। সরকার জনগণের কাছ থেকে যা চেয়েছে, তা তারা দিয়ে গেলেও জনগণের পাওনা পরিশোধ করেনি কোনো সরকারই। বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর শুল্ক দেয়, তা গত ১৪ বছরে আট গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের আদায়কৃত কর ও শুল্কের পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর করসহ রাজস্ব আয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। করজাল সম্প্রসারণ করতে গিয়ে করযোগ্য আয় নেই—তাঁদের ওপরও দুই হাজার টাকা কর আরোপ করা হয়েছে। জনগণের দেওয়া এখানেই শেষ হয় না; এবারও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে যে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, তার দায় জনগণের ওপর চাপাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকছে, পানির দামও বাড়ানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন

দেশের মানুষ যথাসাধ্য করছে। দেশের কৃষি, শিল্প, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ—সব ক্ষেত্রে তাদের শ্রমের স্বাক্ষর। কৃষকেরা দেশের মানুষের খাদ্যশস্য সরবরাহ করছেন, পোশাকশ্রমিকেরা এখন বছরে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে শ্রম দিচ্ছেন, প্রবাসী শ্রমিকেরা প্রতিবছর এখন দেশে পাঠাচ্ছেন প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার (১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি)।

তারপরও দেশে রিজার্ভ–সংকট। গত বছরে রিজার্ভ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, সেখানে এখন তা ৩০ বিলিয়নের নিচে। ঋণ করে উচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প, ব্যক্তিগোষ্ঠীর স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগের সুবিধাভোগী দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠী। কিন্তু সেগুলো একদিকে পরিশোধের চাপ আসছে, অন্যদিকে নানাভাবে অর্থ পাচারের প্রবণতা বৃদ্ধি রিজার্ভ–সংকট তৈরি করেছে। এর থেকে উদ্ধারের কথা বলে আইএমএফের কাছ থেকে বহু রকম শর্ত ও আওয়াজ দিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে।

আইএমএফ এই ঋণ দেবে তিন বছরে, অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করার পর। এ পরিমাণ অর্থ প্রবাসীরা প্রায় প্রতি দুই মাসেই দেশে পাঠাচ্ছেন। সরকারের স্বস্তির জন্য এই ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও জীবনযাত্রার ব্যয়—সবই বেড়েছে। কর–জিডিপি বাড়াতে জনগণের ওপর করজাল সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃহদংশ, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে করজালের বাইরে।

আরও পড়ুন

সমাজে এই প্রশ্নগুলো তাই জোর গলায় তুলতে হবে, কেন ব্যাংকগুলো এত লুণ্ঠনের শিকার হলেও তার অপরাধীরা মহা দাপটে থাকতে পারে? কেন লুট বন্ধ না করে জনগণের টাকা থেকে সেখানে ভর্তুকি দেওয়া হয়? কেন কতিপয় গোষ্ঠীর বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয় ক্যাপাসিটি চার্জের নামে? কেন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বড় ঋণখেলাপি?

কেন বাংলাদেশের সেতু, সড়ক, ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ? কেন বছর বছর পোশাকশ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকদের আয় থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়? কেন তার খবর আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করলেও আমাদের রাজস্ব বোর্ড, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুদক—সবাই গভীর নীরবতায় বসে থাকে?

আরও পড়ুন

কেন কাণ্ডজ্ঞান, জ্ঞানবিজ্ঞান, জনমত—সবকিছুকে অস্বীকার করে রামপাল–রূপপুরের মতো দেশধ্বংসী প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে? কেন জবাবদিহি–ভোটাধিকার ছাড়া সরকারব্যবস্থা চলতে থাকে?

আরও প্রশ্ন তুলতে হবে, কর-জিডিপির অনুপাত নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু কর-সার্ভিসের অনুপাত কেন দেখব না? বাড়তি দাম দিতে থাকব অথচ বিদ্যুৎ পাব না, কর দিতে থাকব, অথচ সার্ভিস পাব না, তা কেন হবে? আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি, বিদ্যুৎ, আমাদের পাট, রেলওয়ে, আমাদের জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে যদি সেই অর্থ ব্যয় না হয়, তাহলে আমরা কর দেব কেন?

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

  • [email protected]