যাঁর হাত ধরে নির্মিত হয়েছিল দেশের একমাত্র দ্বিতল সড়কটি

পরিবেশের ন্যুনতম ক্ষতি করে বানানো হয়েছিল দেশের একমাত্র দ্বিতল সড়কটি। সিআরবি এলাকা, চট্টগ্রামছবি: প্রথম আলো

সংবাদমাধ্যমের কারণে সারা দেশের মানুষের কাছে এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের ‘দ্বিতল সড়ক’। দুই লেনের এই সড়কের একটি লেন ওপরে, অন্যটি নিচে। দেশের অন্যান্য স্বাভাবিক সড়কের চেয়ে এর কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য আলাদা।

আজ থেকে ৪৬ বছর আগে এই সড়ক কেন এভাবে নির্মিত হয়েছিল? তার কারণ জানতে কথা বলেছিলাম প্রকৌশলী ও নগর–পরিকল্পক এ এ এম জিয়া হুসাইনের সঙ্গে।

নবতিপর এই প্রকৌশলী জানালেন, পরিবেশের সুরক্ষার জন্য সড়কটিকে পাহাড়ের ওপরে ও নিচে দুই ভাগ করতে হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা থাকলে পরিবেশের ক্ষতি না করেও যে উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন সম্ভব, তার উদাহরণ আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন এই প্রকৌশলী।

১৯৭৮ সালে এই সড়ক নির্মাণকালে জিয়া হুসাইন ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মোহাম্মদ ইউসফু চৌধুরীর নামে নামকরণ করা সড়কটি ছিল একটি বড় পাহাড়ি আলপথের মতো। অথচ স্টেশন রোড ও সিডিএ অ্যাভিনিউর সঙ্গে সংযোগ ঘটানোর জন্য এই সড়ক প্রশস্ত করা জরুরি। তাতে চট্টগ্রাম নগরের যোগাযোগব্যবস্থা ও ট্রাফিকব্যবস্থায় একটা ইতিবাচক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে, কিন্তু সরু পথ প্রশস্ত করতে হলে পাহাড়ের দুই দিকে কাটতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সেই সময়ে চট্টগ্রাম শহরের জন্য সড়কটি তৈরি করা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু পাহাড় কেটে সাফ করে পরিকল্পনা করতে মন সায় দিচ্ছিল না। অপরিণামদর্শী কোনো কাজ ভালো নয়। শেষ পর্যন্ত তা মানুষের ক্ষতি করে। তখন তাঁর মাথা থেকেই বের হলো এই অভিনব পরিকল্পনা, সড়কটি হবে দুই তলাবিশিষ্ট।

পাহাড়ের ভেতর সংকীর্ণ আদি সড়কটির পাশে প্রতিরক্ষাদেয়াল করে এটির উন্নয়ন করা হবে। আর পাহাড়ের নিচে হবে সড়কের বাকি অংশ। যানবাহন একদিকে যাবে, অন্যদিকে আসবে। পাহাড়ের পাদদেশে নিচের সড়কটির জন্যও প্রতিরক্ষাদেয়াল করার পরিকল্পনা দেওয়া হলো তখন। সড়কের মাঝখানে ওপরে ও নিচে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু দুই প্রান্তে এসে সড়কটি মিশে গেছে।

এ ধরনের সড়কের ধারণার কথা শুনে সেদিন অনেকেই আপত্তি করেছিলেন। ব্যাপারটা কেউ কল্পনা করতে পারছিলেন না বলে জানান এ এ এম জিয়া হুসাইন। দুই লেনের সড়ক সাধারণত পাশাপাশি লাগানো থাকে। কিন্তু একটি অংশ ওপরে, আরেকটি নিচে—এটা আবার কেমন সড়ক।

স্মৃতি হাতড়ে জিয়া হুসাইন বলেন, সে সময় নির্মিত হয়েছিল চট্টগ্রামের নিউমার্কেট নামে পরিচিত বিপণিবিতানটি। নিউমার্কেটের পরিকল্পনায় তিনি একটি চলন্ত সিঁড়ি রেখেছিলেন। তখন এটি ছিল অভিনব ব্যাপার। ষাটের দশকে চলন্ত সিঁড়ির কোনো ভবন ছিল না চট্টগ্রামে। বারবার এর অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে করাচি পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

প্রকৌশলী জিয়া হুসাইনের বয়স এখন ৯০ বছর ৩ মাস। অতীতের অনেক কথা তাঁর কাছে এখন কুয়াশাচ্ছন্ন। সাতকানিয়া হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছেন ১৯৫১ সালে। ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি ভর্তি হন ঢাকার আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ছাত্রজীবন শেষে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে করাচি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে যোগদান করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট টাউন প্ল্যানার হিসেবে। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (সিডিএ) যোগ দেন। সে সময় সিডিএর বয়স মাত্র তিন বছর।

সে সময় পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য নীতির কারণে চট্টগ্রাম তো দূরে থাক, ঢাকারও কোনো উন্নয়ন তেমন হতো না। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যেত না। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সিডিএর কাজ করতে হতো।

স্মৃতি হাতড়ে জিয়া হুসাইন বলেন, সে সময় নির্মিত হয়েছিল চট্টগ্রামের নিউমার্কেট নামে পরিচিত বিপণিবিতানটি। নিউমার্কেটের পরিকল্পনায় তিনি একটি চলন্ত সিঁড়ি রেখেছিলেন। তখন এটি ছিল অভিনব ব্যাপার। ষাটের দশকে চলন্ত সিঁড়ির কোনো ভবন ছিল না চট্টগ্রামে। বারবার এর অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁকে করাচি পর্যন্ত যেতে হয়েছে।

প্রকৌশলী ও নগর–পরিকল্পক এ এ এম জিয়া হুসাইন

নিউমার্কেট তিনতলা করাতে তখনকার মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। সবাই বলেছিল, অত ওপরে কেউ বাজার করতে উঠবে না। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর ওপর একটা ভাসমান সেতুও হয়েছিল। সেটিও কিন্তু পরিবেশবান্ধব ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেটি টিকল না।

জিয়া হুসাইনের মতে, চট্টগ্রাম ছিল পাহাড়ি গাছাপালাবেষ্টিত একটি শহর। এই শহরের পরিবেশটা ধ্বংস হয়েছে মানুষের লোভ–লালসার কারণে। মানুষের দখলমত্ততা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথোপযুক্ত  তদারকির অভাবে চট্টগ্রামের এই হাল হয়েছে। আগে গাছপালার প্রাচুর্য ছিল। পাহাড় ছিল অগুনতি। তার জন্য এগুলোর ওপর যে খড়্গ পড়ত, তা মানুষ খেয়াল করত না। কিন্তু যেতে যেতে যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে, তখন দেখা গেল পরিবেশের মুমূর্ষু অবস্থা।

চট্টগ্রাম শহর থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরমুখী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র‍্যাম্প দ্বিতল সড়কের ওপর যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এতে অনেক গাছ কাটা হতো। এর প্রতিবাদে গণমাধ্যমসহ দেশের সচেতন মানুষ ও পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হলেন। শেষ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।

এ কথা জেনে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, নগর-পরিকল্পনা নিয়ে পড়াশোনা করতে ১৯৬০ সালে এথেন্সে গিয়েছিলেন। সেখানে মিসরীয় স্থপতি হাসান ফাতেহর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। হাসান ফাতেহ কোনো নকশা করার সময় একটা দাগ টেনে অনেকক্ষণ পায়চারী করতেন। ভাবতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিসের এত ভাবনা, কেন এত পায়চারী?

জানতে চাইলে মিসরীয় স্থপতি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি তো একটা রেখা টেনে দিলাম। আর ওদিকে হয়তো কারও বুক বিদীর্ণ হচ্ছে। কেউ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। কোনো কিছু পরিকল্পনা করতে বহু ভাবতে হয়। এ থেকে কী পাব আর কী হারাব—সেই হিসাব–নিকাশ করতে হয়। নইলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

জিয়া হুসাইন বলেন, ‘উন্নয়ন, নগরায়ণের কারণে কিছু গাছপালা, প্রকৃতির বলি হয়। তবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ কারও কাম্য নয়। কাটা পড়া গাছ নতুন করে লাগিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে।’

প্রকৌশলী জিয়া তাঁর চট্টগ্রামের বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। তাঁর সব কটি ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে। অতীত গৌরবের নানা স্মৃতির মধ্যে তিনি বললেন, ‘চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামের কাছে একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে করমর্দন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মুজিবের হাত তাঁর হৃদয়ের মতো কোমল ছিল। অনেক বড় হাত। সেই হাতের স্পর্শের স্মৃতি আজও আমাকে আন্দোলিত করে।’

জিয়া হুসাইন সিডিএতে কাজ করেছেন। সরকারি নির্দেশে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটিতে (বেপজা) কাজ করেছেন। চট্টগ্রামের ইপিজেডও গড়ে উঠেছে তাঁর হাত ধরে।

তিনি বলেন, ‘সব কাজেই পরিবেশের বিষয়টা মাথায় রেখেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে ’৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল না। জনবান্ধব ছিল না প্রশাসন। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি সবকিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা চিন্তায় আনেনি।’

জিয়া হুসাইনের স্মৃতি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাঁর হাত ধরে যে সড়কটি হয়েছিল পরিবেশ রক্ষা করে, সেটির পরিবেশ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করবে তাঁরই উত্তরসূরিরা। সে আশা শুধু একটি সড়কের বেলায় নয়, পুরো দেশের সব কাজের জন্য।

  • ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক ও কবি