হুমকি-মামলা সব তো হলো, এবার আলোচনা হোক

নিজেদের ধারণা অনুযায়ীই হোক বা উপরি আদায়ের জন্যই হোক, যদি ইচ্ছেমতো কর নির্ধারণ করেন, তাহলে নগরবাসীর হতাশার সীমা থাকে না
ছবি : প্রথম আলো

কোনো সন্দেহ নেই, চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের একজন বর্ষীয়ান নেতা সিটি করপোরেশনের মেয়রকে বেশ ‘অভব্য’ ভাষায় আক্রমণ করেছেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দিতে গিয়ে পরিষদের সভাপতি নুরুল আবসার মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে ‘তুই-তোকারি’ তো করেছেনই, উপরন্তু চট্টগ্রামছাড়া করার হুমকিও দিয়েছেন।

ধারণা করি, দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বর্তমান মেয়রের পক্ষ থেকে দাবি মেনে নেওয়ার কোনো আশ্বাস না পেয়ে অন্য অনেকের মতোই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন, জনসভায় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর বক্তব্যে।

তিনি বলেছেন, কারও দয়ায় নয়, বিদ্যুৎ, পানি, আয়কর, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি ১১ রকমের কর দিয়ে এ শহরে মানুষ বসবাস করছে, কারও দয়ার ওপর নির্ভর করে নয়। বক্তব্যের এ পর্যায়ে গৃহকর বাড়ানোর একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে মেয়রকে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

‘অভব্য’ শব্দটি আগেই উল্লেখ করেছি। মেয়রকে চট্টগ্রাম শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা ও আঞ্চলিক ভাষায় কটাক্ষ করা বিজ্ঞজনোচিত নয়, বলাই বাহুল্য। কারণ, মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী বহদ্দার বাড়ির বাসিন্দা তো বটেই, তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতি করারও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে তাঁর, সর্বোপরি তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

 ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। এ সংগঠনের সভাপতির মনে রাখা দরকার, মাঠ গরম করা নয়, তাঁর দায়িত্ব এ সংগঠনের পক্ষ থেকে করের বোঝা লাঘবের জন্য সিটি করপোরেশনের সঙ্গে দর-কষাকষি করা। যা–ই হোক, বক্তৃতার মঞ্চ এমন এক ‘প্রেরণা’ বা ‘প্ররোচনাসঞ্চারী’ স্থান, যেখানে শ্রোতাদের উত্তেজনা বক্তাকেও অতি উত্সাহী করে তোলে। ক্ষোভের প্রকাশটা তাই হয়তো একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া যেভাবে দেখালেন মেয়র মহোদয় ও তাঁর কয়েক সহকর্মী, সেটাকেও যুক্তিসংগত মনে হয়নি আমাদের। কারণ, এ ধরনের মাঠের ভাষার সঙ্গে রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিচয় নেই, তা তো নয়। এককালে তিনি সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে করপোরেশনের আয় বৃদ্ধির জন্য নানা রকম প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, এর কিছু খুবই প্রশংসিত হয়েছে, কিছু প্রকল্প সমালোচিতও হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁর মনোভাব ছিল পরিষ্কার—তিনি কখনোই নগরবাসীর ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাননি। এই গণমুখী চরিত্রই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তার প্রধান ভিত্তি। এই সহজ শিক্ষাটা গ্রহণ করলে নগর পরিচালনার কাজটি অনেক সহজতর হয়ে ওঠে বলে আমাদের ধারণা।

মহিউদ্দিনকে এ এলাকার মানুষ কতবার মাথায় তুলেছেন আর কতবার মাটিতে নামিয়েছেন—সেসব ঘটনার তো তিনি প্রত্যক্ষদর্শী! কিন্তু নাগরিকদের কড়া সমালোচনার মুখে তিনি কারও বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়েছেন—এমন নজির কি আছে?

শুধু মহিউদ্দিন চৌধুরী কেন, সাবেক মেয়র মনজুর আলম থেকে আ জ ম নাছির উদ্দীন পর্যন্ত কেই–বা সমালোচক বা বিক্ষুব্ধ নাগরিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন? সত্যি কথা বলতে কী, সমালোচনা বা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার (এমনকি তা অভব্য হলেও) বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করার বিষয়টি যতটা ‘কতৃ৴ত্বপরায়ণ’ আচরণ, ততটা জনপ্রতিনিধিসুলভ নয়।

 ‘করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’–এর পক্ষ থেকে সভাপতির বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। তারপরও মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। এদিকে পরিষদও তাদের দাবি থেকে সরে আসেনি। নিয়মিত উঠান বৈঠক, গণশুনানি, মিছিল-সমাবেশের মতো কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।

সুরক্ষা পরিষদের বক্তব্য, দেশের কোনো সিটি করপোরেশন বা পৌর এলাকায় স্থাপনার ভাড়ার ওপর গৃহকর ধার্যের নজির নেই। আবাসিক এলাকায় আয়তনের ওপর কর ধার্য করাটাই যৌক্তিক বলে তাদের দাবি। ১৯৮৬ সালে বাড়িঘরের ভাড়ার ওপর কর ধার্য করার নিয়মটি গৃহীত হয়েছিল।

কিন্তু দীর্ঘ ৩৮ বছর তা কার্যকর করা হয়নি বা যায়নি। পূর্ববর্তী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন একবার নিয়মটি চালু করতে গেলে নগরবাসীর আন্দোলনের মুখে স্থানীয় সরকার পরিষদ তা স্থগিত করে দেয়। বর্তমান মেয়র ক্ষমতায় এসে স্থানীয় সরকার বরাবর আবেদন জানালে তারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। এতে পুরোনো দ্বন্দ্বটি নতুন করে চাঙা হয়ে ওঠে।

এ কথা তো ঠিক, নগরে বাস করতে হলে নাগরিক সুবিধাদি ভোগ করতে হলে, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত কর পরিশোধ করা নাগরিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু যে নিয়মটি আগের বিভিন্ন মেয়রের আমলে চেষ্টা করেও কিছুতেই চালু করা যায়নি, সেই অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তটি কেন বর্তমান মেয়র গ্রহণ করলেন, তা কিছুতেই বোধগম্য নয়।

মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে করপোরেশনের আয় বৃদ্ধির জন্য নানা রকম প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, এর কিছু খুবই প্রশংসিত হয়েছে, কিছু প্রকল্প সমালোচিতও হয়েছে। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁর মনোভাব ছিল পরিষ্কার—তিনি কখনোই নগরবাসীর ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাননি। এই গণমুখী চরিত্রই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তার প্রধান ভিত্তি। এই সহজ শিক্ষাটা গ্রহণ করলে নগর পরিচালনার কাজটি অনেক সহজতর হয়ে ওঠে বলে আমাদের ধারণা।

এবার আসি মূল বিরোধ প্রসঙ্গে। ১৯৮৬ সালে বাসাবাড়ির ভাড়া অনুযায়ী গৃহকর নির্ধারণের আইন চালু হওয়ার পর থেকেই এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নগরবাসী। যদিও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে ধার্যকৃত কর গৃহমালিকের পক্ষে অতিরিক্ত মনে হলে তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানাতে পারবেন।

করপোরেশন এসব আবেদন পুনর্বিবেচনা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করেছে। কিন্তু এই পদ্ধতিকে একধরনের ভোগান্তি এবং করুণা প্রার্থনা বলে মনে করছেন গৃহমালিকেরা। উপরন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা চেনাশোনার সুবাদে কারও কারও এ ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা লাভ, আবার কারও ক্ষেত্রে যোগাযোগের অভাবে বঞ্চিত হওয়ার ব্যাপারও ঘটতে পারে।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর ধার্য করার অনিয়ম সম্পর্কে আমাদের হাতে আসা সাম্প্রতিক একটি গৃহকরের উদাহরণ এখানে তুলে ধরতে পারি। কে এম মুস্তাফিজুর কবির নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা (বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক) জানিয়েছেন, আগ্রাবাদ সরাইপাড়ার মতো একটি প্রায় উন্নয়নবঞ্চিত এলাকায় তাঁর সাড়ে চারতলা বাড়িটির কর ১০ হাজার টাকা থেকে বর্তমানে একলাফে পৌঁছেছে ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকায়।

আবেদন করে আপিল কমিটির সঙ্গে দর-কষাকষি করে তিনি এর কতটাই–বা কমাতে পারবেন, ভেবে কপালে ভাঁজ পড়েছে তাঁর। এ ধরনের উদাহরণ আরও অনেক আছে।

আরও পড়ুন

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি—এসব কারণে যখন সাধারণ মানুষ দিশাহারা, শহরের মানুষের পরিবার গ্রামে স্থানান্তরের দৃশ৵ যখন আমাদের নতুন এক অভিজ্ঞতা, তখন বাড়িভাড়া কমাতে বাধ৵ হয়েছেন অনেক গৃহমালিক।

এসব কথা সরেজমিন কর ধার্য করতে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্বাস না–ও হতে পারে, তাঁরা নিজেদের ধারণা অনুযায়ীই হোক বা উপরি আদায়ের জন্যই হোক, যদি ইচ্ছেমতো কর নির্ধারণ করেন, তাহলে নগরবাসীর হতাশার সীমা থাকে না। এই হতাশা বা ক্ষোভ থেকেই আন্দোলনের সৃষ্টি। নির্দলীয় এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত না ভেবে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সঙ্গে সমঝোতায় বসলে মেয়র মহোদয় নগরবাসীর প্রকৃত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

[email protected]