দেশের গরিবদের প্রতিনিধিরা এত ধনী হন কী করে!

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩। ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। একই সময় দেশে অতিদারিদ্র্যের হারও কমেছে। দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্যের হার বছরে কমছে কমবেশি ১ শতাংশ হারে।

এর সঙ্গে ধনীদের প্রবৃদ্ধিটা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচন হলো ৮ মে। এই নির্বাচনে ভোটারের হার কেন কম, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ চলছে। কেউ বিএনপিকে, কেউ আওয়ামী লীগকে দায়ী করছেন। আমরা সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। দেখতে চাইছি, যাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির হারটা কেমন ছিল।

প্রার্থীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে টিআইবি বলছে, ১০ বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি সম্পদ বেড়েছে গাজীপুরের কাপাসিয়ার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রওশন আরা সরকারের। ১৮ হাজার ২৩৩ শতাংশ। এরপরই রয়েছেন গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রীনা পারভীন। তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১০ হাজার ৭৪ শতাংশ।

গত উপজেলা নির্বাচনে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন ৩৭ জন, এবার ৯৪ জন। অনেকের অবিশ্বাস্য ও গগনচুম্বী হারে আয় ও সম্পদ বেড়েছে। প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশই ব্যবসায়ী। কোটিপতি আছেন ৯৪ জন। গতবারের তুলনায় এবার কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের মধ্যে ১৭ জন কোটিপতি এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের মধ্যে কোটিপতি ৬ জন। সব পদের প্রার্থী মিলিয়ে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১১৭। টিআইবি বলেছে, অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে এই কোটিপতির হিসাব করা হয়েছে। ভূমির মতো স্থাবর সম্পদের মূল্য নির্ধারণ কঠিন হওয়ায় কোটিপতির হিসাবে তা আনা হয়নি।

দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ গরিব, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত। কিন্তু তাঁদের জন্য যাঁরা রাজনীতি করেন, যাঁরা জনপ্রতিনিধি হন, যাঁরা রাষ্ট্র ও প্রশাসনের মালিক–মোক্তার, তাঁদের কেউ গরিব বলে শুনিনি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ—গরিবের দেখা মেলা ভার।  

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে জনপ্রতিনিধি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছিল। পরে তারা সেখান থেকে পিছিয়ে আসে। এখন নেতারা বলছেন, হিসাব তো এনবিআরে দেওয়া আছে, আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন কী।

তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকায় প্রার্থীদের হলফনামায় আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব দিতে হয়। এ কারণে বর্তমান ও হবু জনপ্রতিনিধিদের সম্পদের হিসাবটা জানা যায়। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের ফারাকটাও মিলিয়ে নেওয়া যায়। 

প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ৬৯ দশমিক ৮৬ শতাংশই নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। অস্থাবর সম্পদের তালিকার শীর্ষে আছেন গোপালগঞ্জ সদরের চেয়ারম্যান প্রার্থী কামরুজ্জামান ভূঁইয়া। তাঁর মোট অস্থাবর সম্পদ ২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এরপরই আছেন রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আনোয়ারুল ইসলাম। তাঁর সম্পদ ২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

টিআইবির বিশ্লেষণে এসেছে, জমির মালিকানার দিক দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন আট প্রার্থী। আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই সংখ্যাটা বহু গুণ বেশি হবে। আইনি সীমা অতিক্রমকারীরাই আমাদের আইনপ্রণেতা ও সেবক। 

আমরা যদি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের কথা বলি, তাঁরা সবাই ধনী। কেউ কেউ অতিধনী। কিন্তু ভোটারদের অধিকাংশ গরিব কিংবা অতিগরিব। আগে দু–চারজন গরিবও নির্বাচিত হতেন। এখন কোনো গরিব নির্বাচন করারই সাহস পাবেন না। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের জামানত বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭৫ হাজার টাকা। কোনো গরিবের পক্ষে এই টাকা জামানত রাখা সম্ভব নয়।

২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনের তুলনায় আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে খাগড়াছড়ির রামগড়ের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিশ্ব প্রদীপ কুমার কারবারি। তাঁর সম্পদ বেড়েছে ৩ হাজার শতাংশের বেশি। ১ হাজার শতাংশের বেশি আয় বেড়েছে আরও চার প্রার্থীর। 

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং এবারের উপজেলা নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের সম্পদের বিবরণ দেখে কে বলবে যে বাংলাদেশ গরিব! ‘গরিব বাংলাদেশ’ জাতীয় সংসদ কিংবা সচিবালয়ে থাকে না, জেলা কিংবা উপজেলা পরিষদে থাকে না। গরিব বাংলাদেশ থাকে শহরের বস্তিতে, কারখানায়, ফসলের মাঠে কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দীর্ণ চেহারায়।  

পাকিস্তান আমলে দুই অর্থনীতি ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি অনেক উন্নত ছিল। বাজেটের সিংহভাগও ব্যয় হতো সেখানে। পাকিস্তানিদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য ও শোষণ কমেনি। আগে বিদেশিরা আমাদের শোষণ করত। এখন বাংলাদেশিরাই বাংলাদেশিদের শোষণ করে।

আরও পড়ুন

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত—শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ কিন্তু আওয়ামী লীগের বর্তমান অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি দেখে মনে হয়, শোষকদের রক্ষা করতেই তারা সচেষ্ট। ব্যাংকিং খাত থেকে যে হাজার কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে, তার পক্ষেও সংসদে সাফাই গাওয়া হয়। বলা হয়, ‘ঋণখেলাপি সংস্কৃতি শুরু হয়েছে জিয়াউর রহমানের আমলে। এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে তার প্রসার ঘটেছে।’ অন্যের সমালোচনা করা সহজ। কঠিন হলো বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া।

সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের জীবনমান ইউরোপের মানুষের সমান। কিন্তু নিচের দিকের চার কোটি মানুষ যে দুঃসহ দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের যে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সেই খবর কি জনপ্রতিনিধিরা রাখেন?

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। গ্রামের মানুষের চেয়ে শহরের মানুষের আয় অনেক বেশি। শহরের একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ১০ হাজার ৯৫১ টাকা। আর গ্রামের মানুষের আয় ৬ হাজার ৯১ টাকা।

গড়টা ধরা হয় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উপার্জনকারী মানুষের আয় ধরে। ধরুন একজন মানুষ মাসে এক লাখ টাকা আয় করেন। আরেকজন মানুষ কোনো আয় করেন না। এই দুজনের গড় আয় হবে ৫০ হাজার টাকা। এর অর্থ এই নয় যে আয় না করা মানুষটি আয় করা মানুষটির আয়ের ভাগ পাবেন। বাংলাদেশে উন্নয়নের পাশাপাশি আয়বৈষম্যও বেড়েছে। দেশের মোট আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ করেন সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ। সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের হাতে মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

আমরা যদি নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের কথা বলি, তাঁরা সবাই ধনী। কেউ কেউ অতিধনী। কিন্তু ভোটারদের অধিকাংশ গরিব কিংবা অতিগরিব। আগে দু–চারজন গরিবও নির্বাচিত হতেন। এখন কোনো গরিব নির্বাচন করারই সাহস পাবেন না। উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থীদের জামানত বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭৫ হাজার টাকা। কোনো গরিবের পক্ষে এই টাকা জামানত রাখা সম্ভব নয়।

কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েলথ-এক্স জানিয়েছিল, অতিধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলেছে। ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। এসব ধনকুবেরের কিছু তথ্য প্রার্থীদের হলফনামায় পাওয়া গেল। বাকিটা জানতে হয়তো মালয়েশিয়া, আবুধাবিতে গড়ে ওঠা সেকেন্ড হোম কিংবা কানাডার বেগমপাড়ায় খোঁজ নিতে হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]