শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলার মাহাত্ম্য

পৃথিবী যখন অধর্মের প্রাদুর্ভাবে ভক্ত ও সাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, তখন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য কৃপা করে ভক্তের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে ঈশ্বর ‘অবতার’ রূপ নিয়ে থাকেন। তখন তিনি ষড়্‌গুণ যথা ঐশ্বর্য, বীর্য, তেজ, জ্ঞান, শ্রী ও বৈরাগ্যসম্পন্ন ‘পূর্ণাবতাররূপে’ প্রকাশিত হন। সনাতন ধর্মের দশ অবতারের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ অষ্টম অবতার। তাঁর ঐশ্বর্য ও মাধুর্যময় কার্যাবলি বিবেচনায় ধর্মশাস্ত্রজ্ঞরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জন্ম নিয়ে নিজেই বলেছেন, তাঁর জন্ম-মৃত্যু সাধারণ মানুষের মতো নয়। মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং মারা যায়। তিনি বলেছেন, ‘আমি জন্মরহিত হয়েও আবির্ভূত হই এবং অবিনশ্বর হয়েও অন্তর্ধান করে থাকি। আবির্ভূত হওয়া ও অন্তর্হিত হওয়া—দুটিই আমার অলৌকিক লীলা।’ শ্রীকৃষ্ণের অন্য সব লীলার মতো তাঁর জন্মলীলাতেও সুগভীর অধ্যাত্মতত্ত্ব রয়েছে।

দ্বাপর যুগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির রোহিণী নক্ষত্রে বসুদেব-দেবকীর কোলে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। অষ্টমী তিথিতে দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মেছিলেন বলে এই তিথি জন্মাষ্টমী তিথি নামে পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল রাজ্যবাসী। পৃথিবীকে পাপাভার থেকে মুক্ত করাই ছিল শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য।

বসুদেব জীবাত্মা বা প্রাণ। বসু মানে প্রাণ, দেব মানে অধিপতি। দশ প্রাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে প্রাণ। তাই তাঁকে বলা হচ্ছে বসুদেব। দেবকী দৈব প্রকৃতি দৈবী শক্তি। প্রাণের সঙ্গে দৈবী শক্তির মিলন যদি সাধনায় ঘটে, তখন সাধকচিত্তে ভগবানের আবির্ভাব ঘটে। বসুদেব ও দেবকী শ্রেষ্ঠ সাধক ও সাধনার শক্তি। এ দুয়ের মিলনে ভগবানের জন্ম।

ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি—এককথায় সর্ববিধ জীবনাচরণের ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী যুগান্তকারী ঘটনা। নিরাকার পরব্রহ্ম ভগবানের সাকার রক্ত–মাংসের দেহধারী প্রকাশ সুগভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আধিভৌতিক, আদিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক জগতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনুধ্যানের দাবি রাখে।

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কংসের কারাগারে। কামনার কারাগার হলো কংসের কারাগার। হাজার কামনার খাঁচা এই দেহ। এই কংসের কারাগার মথুরায় অবস্থিত। মথ্ মানে মন্থন করা। কামক্রোধাদি রিপুসমূহ অবিরত এই দেহকে মন্থন করে চলেছে। অতএব এই দেহ মথুরা। এর অধিপতি কংস। সে কামনার অধিপতি। কংস ধনুর্যজ্ঞ করে। এই ধনু ইন্দ্রধনু, মানে ইন্দ্রিয় ধনু কামনা চরিতার্থতার কৌশল। এই ধনু ভঙ্গ করে রামচন্দ্র সীতাকে লাভ করেছিলেন। এই ধনুককে ভাঙতে হয়। কিন্তু কামী কংস এই ধনু রক্ষা করার জন্য যজ্ঞ করে। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কামনা ভোগ করার কৌশল কামীজনেরা আয়ত্তে রাখতে চায়। ভগবানের আবির্ভাব হলে কামনার বিনাশ ঘটে। তাই দেখানো হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের হাতে কংসের বিনাশ।

শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ভাদ্র মাসে। ভদ্র+ষ্ণ=ভাদ্র। ভাদ্র মানে মঙ্গল। এই মাস মঙ্গলকর হয়েছিল ভগবানের আবির্ভাবে। আবির্ভাব কৃষ্ণপক্ষে অষ্টমী তিথিতে। কৃষ্ণপক্ষ চন্দ্রের ক্রমক্ষীয়মাণ অবস্থা। শাস্ত্রে মনকে চন্দ্র বলা হয়েছে। চন্দ্রের যেমন হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, মনেরও তেমন হয়। মন ইন্দ্রিয়ের রাজা। মন যতক্ষণ প্রবল থাকে, ততক্ষণ চিত্ত চঞ্চল থাকে। কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মনশ্চন্দ্র অর্ধেক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। তখন চিত্তে ভগবানের আবির্ভাব সম্ভব।

আরও পড়ুন

ঈড়া ভগবতী গঙ্গা, পিঙ্গলা যমুনা নদী। পিঙ্গলারূপী যমুনা নদীর তীরে শ্রীকৃষ্ণের কত লীলা! দেবকীর অষ্টম গর্ভে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। অষ্টভূতে, অষ্টপ্রকৃতিতে ব্রহ্মা রচিত। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম রোহিণী নক্ষত্রে। রুহ্‌+ইন্‌ করে ‘রোহিণী’ শব্দের উৎপত্তি। রুহ অর্থ উৎপত্তি হওয়া। মন অনবরতই উৎপন্ন করে থাকে। উৎপত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ উৎপত্তি ভগবদুৎপত্তি। উৎপত্তি করে বলে মনরূপী চন্দ্র রোহিণী বেশি সঙ্গ করে।

নবজাতক কৃষ্ণকে কারাগার থেকে যমুনা পার হয়ে নন্দালয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, সাপ ফণা বিস্তার করে আছে। এই সাপ হলো সাধকের দেহস্থ জাগ্রতা কু-লিনী শক্তি। সাধক সাধনার এই কু-লিনী শক্তিকে পরাভূত করে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত উত্থিত করেন।

ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি—এককথায় সর্ববিধ জীবনাচরণের ক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী যুগান্তকারী ঘটনা। নিরাকার পরব্রহ্ম ভগবানের সাকার রক্ত–মাংসের দেহধারী প্রকাশ সুগভীর তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। আধিভৌতিক, আদিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক জগতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনুধ্যানের দাবি রাখে।

  • তারাপদ আচার্য্য সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ