সাবিনার একজোড়া জুতা ও স্বপ্নপূরণের বিশ্ববিদ্যালয়

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার হাতে সাবিনা
ছবি: বাফুফে

ইরানি চলচ্চিত্রকার মজিদ মাজিদির অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য চিলড্রেন অব হ্যাভেন’ সিনেমাটির কথা অনেকের হয়তো মনে আছে। সামান্য একজোড়া জুতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মানবিক আবেদনের এ সিনেমা। হতদরিদ্র আলী ও তার বোনের স্কুলে যাওয়ার জন্য ছিল মাত্র একজোড়া জুতা। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সিনেমাটির শেষ দিকে তারা যখন আরেক জোড়া জুতা লাভ করে, সে দৃশ্য কাঁদিয়েছিল সারা পৃথিবীর দর্শকদের।

সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষও কেঁদেছিল আনন্দে। সাফ নারী ফুটবলে সাবিনার ফুটবল দলের অভাবনীয় সাফল্যে।

আরও পড়ুন

এই সাবিনারও রয়েছে একজোড়া জুতার গল্প। সাবিনাও বেড়ে উঠেছেন তেহরানের আলীর পরিবারের মতোই সাতক্ষীরার এক দরিদ্র পরিবারে। পরিবারের সদস্য ছিল সাতজন। আয়ের একমাত্র উৎস ছিলেন বাবা। বাবা মারা গেলে সাবিনারা খুবই বিপাকে পড়েন। তাঁর খেলার জন্য ছিল মাত্র একজোড়া জুতা। স্কুলে যাওয়ার জন্য কোনো জুতা ছিল না। কিন্তু এ জন্য স্কুল কোনো বাদ সাধেনি। কেননা, তিনি পড়ালেখা করতেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় স্টাডি সেন্টারে। যেতেন শুক্রবার ছুটির দিনে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখায় নেই কোনো নির্দিষ্ট ড্রেস কোড। নেই পড়ালেখার নির্দিষ্ট বয়স ও সময়। যেকোনো বয়েসের, যেকোনো শ্রেণির মানুষ এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিজের সুবিধামতো স্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। সাবিনা এখান থেকেই এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। এখন ক্রীড়াচর্চার পাশাপাশি পড়ালেখা করছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতক পর্যায়ে। পূরণ করে চলেছেন তাঁর উচ্চশিক্ষার স্বপ্নও।

আরও পড়ুন

সাবিনার মতো এ রকম অসংখ্য মানুষের শিক্ষা লাভের স্বপ্ন পূরণ করে চলেছে যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাকে বলে উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ।
আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা করার কঠিন শর্ত থাকে অনেক। নির্দিষ্ট বয়সে নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হতে হয় সে শিক্ষা নিতে হলে। জীবনযুদ্ধে নেমে পড়া মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া এ ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুলও। গত শতাব্দীতেই এ নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল ইউরোপে। কী করে জীবনে বিপাকে পড়া ভাগ্যতাড়িত মানুষকে শিক্ষার অধিকার প্রদান করা যায়।

চালু করা হয়েছিল ডাকযোগে বা পত্রিকার মাধ্যমে পড়ালেখা, নৈশ বিদ্যালয়। রেডিও–টিভি আবিষ্কৃত হলে ব্যবহার করা হয়েছিল সে মাধ্যম। পরে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হলে এ ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত হয়। এ শিক্ষাব্যবস্থার মূল দর্শনকে বলা হয় উন্মুক্ত শিক্ষাদর্শন আর পড়ানোর পদ্ধতিকে বলা হয় দূরশিক্ষণ। মানে পড়ার জন্য যেকোনো বয়েসের যেকোনো মানুষকে যেকোনো সময় উন্মুক্ত, আর পড়তে পারবেন দূরে বসেই যোগাযোগের যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করে। সব বয়স ও শ্রেণির, বিশেষত সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষের জন্য এ এক অনন্য, মহৎ শিক্ষাপরিকল্পনা।

এ শিক্ষাব্যবস্থার মূল দর্শনকে বলা হয় উন্মুক্ত শিক্ষাদর্শন আর পড়ানোর পদ্ধতিকে বলা হয় দূরশিক্ষণ। মানে পড়ার জন্য যেকোনো বয়েসের যেকোনো মানুষকে যেকোনো সময় উন্মুক্ত, আর পড়তে পারবেন দূরে বসেই যোগাযোগের যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করে

এ দর্শন ও ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রথম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় লন্ডনে ১৯৫৯ সালে ‘দ্য ওপেন ইউনিভার্সিটি’ নামে। তারপর গড়ে উঠতে থাকে সারা দুনিয়াতেই। ভারতে ‘ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি’, পাকিস্তানে ‘আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটি’, ‘শ্রীলঙ্কা ওপেন ইউনিভার্সিটি’।

এ ব্যবস্থার সুবিধা ও যৌক্তিকতা লক্ষ্য করে পৃথিবীর নামকরা সনাতন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও মুখোমুখির ব্যবস্থার সঙ্গে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাও চালু করেছিল। করোনা মহামারির সময় এ ব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল বিশ্বের একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা। করোনা-উত্তরকালেও এ পদ্ধতির সুবিধা হাতছাড়া করা হচ্ছে না। চালু রাখা হচ্ছে মিশ্র পদ্ধতি। অর্থাৎ, দূর ও সরাসরি শিক্ষার সমন্বিত শিক্ষাপদ্ধতি।

স্বাধীনতা–উত্তরকালে বাংলাদেশে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির শিক্ষা প্রথম চালু হয় ১৯৮৫ সালে বাইড নামে। সে ব্যবস্থাকেই আরও সংহত করে পরে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’। এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়টি তার প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর অতিক্রম করছে। এটি বর্তমানে একটি মেগা বিশ্ববিদ্যালয়। এর বর্তমান শিক্ষার্থীসংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় গত ৩০ বছরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ৩১ লক্ষাধিক মানুষ।

তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন ক্ষুদ্র পেশাজীবী, কারখানার শ্রমিক, দিনমজুর, তেমনি রয়েছেন সিনিয়র সচিব, সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রয়েছেন শিল্পী, সাংবাদিক, কবি–সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ থেকে বারাক ওবামার স্টাফ ফটোগ্রাফার। বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিবর্তন করে চলেছে বহু মানুষের জীবনমান, পূরণ করে চলেছে শিক্ষার স্বপ্ন।

উন্নত পৃথিবীর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রহণ করা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় অভ্যস্ত মানুষ এ ব্যবস্থাকে এখনো খানিকটা দ্বিধা ও সন্দেহের চোখে দেখেন। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বাউবিরও রয়েছে নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা। প্রতিষ্ঠানটি এখনো মূলত অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থান ও লোকবল ভাড়া করে তাদের পরীক্ষা কার্যক্রম ও সম্পূরক টিউটোরিয়াল শিক্ষা পরিচালনা করে। এ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যে গাজীপুরের নিজস্ব ক্যাম্পাসে এ ব্যবস্থাকেও ধীরে ধীরে নিয়ে আসছে। মহাপরিকল্পনা নিয়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থাপনার। গ্রহণ করছে প্রযুক্তির আধুনিকতম সুবিধাসমূহ। শিগগিরই তারা হয়তো কাটিয়ে উঠবে তাদের চ্যালেঞ্জগুলো।

সাবিনাদের মতো সংগ্রামী অনন্য মানুষের স্বপ্নপূরণের এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ২১ অক্টোবর তার ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।

  • শোয়াইব জিবরান: কবি, লেখক ও শিক্ষাবিদ।